নির্বাচন নিয়ে ভারতের 'নসিহতে' বাংলাদেশের তীব্র প্রতিক্রিয়া কেন?
কাগজ ডেস্ক
প্রকাশ: ১৮ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৪:৩২ পিএম
ছবি : সংগৃহীত
বাংলাদেশে ‘সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক’ নির্বাচন আয়োজনের আহ্বান জানিয়ে ভারতের দেওয়া সাম্প্রতিক বক্তব্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে বাংলাদেশ। বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বলেন, বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে ভারতের দেওয়া ‘নসিহতের’ কোনো প্রয়োজন নেই।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে নির্বাচন কেমন হবে, তা নিয়ে আমরা আমাদের প্রতিবেশীদের উপদেশ চাই না। এ বিষয়ে দিল্লির ভূমিকাকে তিনি সম্পূর্ণভাবে ‘অগ্রহণযোগ্য’ বলে মন্তব্য করেন।
এর আগে একইদিন ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে দেওয়া এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বাংলাদেশে একটি সুষ্ঠু, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন আয়োজনের আহ্বান জানানো হয়। এর তিন দিন আগেও, ১৪ ডিসেম্বর প্রকাশিত আরেকটি বিজ্ঞপ্তিতে একই ধরনের বক্তব্য দেওয়া হয়েছিল।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকদের মতে, বাংলাদেশের এই তীব্র প্রতিক্রিয়ার পেছনে অন্তত তিনটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে—বাংলাদেশে অতীতে অনুষ্ঠিত তিনটি বিতর্কিত নির্বাচনের সময় ভারতের সমর্থনমূলক অবস্থান, ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফেরত না দেওয়া এবং আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে ভারতের ভূমিকা নিয়ে সন্দেহ।
শেষ তিন নির্বাচনে ভারতের বিতর্কিত ভূমিকা
ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকাকালীন আয়োজিত শেষ তিনটি নির্বাচনই নানা কারণে বিতর্কিত ছিল। অভিযোগ রয়েছে, এসব নির্বাচনকে বৈধতা দেওয়ার ক্ষেত্রে ভারত কখনো সরাসরি, আবার কখনো পরোক্ষভাবে ভূমিকা রেখেছে।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক ও গবেষক আলতাফ পারভেজ ২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচনের প্রসঙ্গ তুলে ধরেন। তার মতে, ওই নির্বাচনের আগে জাতীয় পার্টিকে নির্বাচনে আনতে দলটির তৎকালীন চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদকে ‘হাসপাতালে রাখার’ ঘটনাও গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের প্রতিবাদে তৎকালীন প্রধান বিরোধী দল বিএনপি নির্বাচন বর্জন করেছিল। জাতীয় পার্টিও শুরুতে বর্জনের ঘোষণা দিলেও পরে এরশাদ হাসপাতালে থাকা অবস্থায় তার স্ত্রী রওশন এরশাদের নেতৃত্বে দলটি নির্বাচনে অংশ নেয়।
ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ১৫৩ জন প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হলেও জাতীয় পার্টির অংশগ্রহণের কারণে আওয়ামী লীগ এটিকে ‘অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন’ হিসেবে দাবি করে।
নির্বাচন ঘিরে টানাপোড়েনের সময় বাংলাদেশ সফরে আসেন ভারতের তৎকালীন পররাষ্ট্রসচিব সুজাতা সিং। তিনি এরশাদের সঙ্গেও বৈঠক করেন। আলতাফ পারভেজ বিবিসি বাংলাকে বলেন, এরশাদকে বিরোধী ভূমিকা থেকে সরানো হয়েছে এবং এক্ষেত্রে ভারতের পররাষ্ট্রসচিব সরাসরি এসে ভূমিকা পালন করেছেন।
তার মতে, ২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচন এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির পর আওয়ামী লীগ সরকারকে ভারত সরাসরি সমর্থন ও অনুমোদন দিয়েছে এবং নির্বাচনি বৈতরণী পার হতে সহায়তা করেছে।
অনেক বিশ্লেষকের ধারণা, ভারতের এই সমর্থনের কারণেই যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলো বিতর্কিত নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে প্রকাশ্যে জোরালো আপত্তি তোলেনি।
২০২৪ সালের নির্বাচনের পরও ভারতসহ কয়েকটি দেশ শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাকে অভিনন্দন জানায়। এর কিছুদিন পর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, বিরোধীরা বিদেশি শক্তির সহায়তায় নির্বাচন ভন্ডুল করতে চাইলেও “ভারত পাশে দাঁড়িয়েছিল।”
এই প্রসঙ্গ টেনে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বলেন, গত ১৫ বছর ধরে যে সরকার ছিল, তাদের সঙ্গে ভারতের অত্যন্ত মধুর সম্পর্ক ছিল। তখন কিন্তু প্রহসনমূলক নির্বাচন নিয়ে তারা একটি শব্দও উচ্চারণ করেনি। এখন যখন আমরা ভালো নির্বাচনের দিকে যাচ্ছি, তখন আমাদের নসিহত করার প্রয়োজন নেই।
তিনি আরো বলেন, আমরা এমন একটি নির্বাচন করবো, যেখানে মানুষ ভোট দিতে পারবে এবং যাদের ভোট দেবে তারাই নির্বাচিত হবে—যা গত ১৫ বছরে ঘটেনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক আমেনা মহসীন মনে করেন, অতীতের প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকার কারণে ভারতের এমন মন্তব্যে প্রতিক্রিয়া হওয়াই স্বাভাবিক। তিনি প্রশ্ন তোলেন, আজ যখন অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের কথা হচ্ছে, তখন কেন ভারতের মুখ থেকেই এসব কথা আসছে?
শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ পুনর্বাসন নিয়ে সন্দেহ
গত বছরের ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের মুখে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশ ছাড়েন এবং এরপর থেকে তিনি ভারতে অবস্থান করছেন। বাংলাদেশ সরকার একাধিকবার তাকে বিচারের জন্য ফেরত চাইলেও ভারত এ বিষয়ে কোনো সাড়া দেয়নি।
এদিকে ভারতের কলকাতাসহ বিভিন্ন স্থানে বাংলাদেশে নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা আশ্রয় নিয়েছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের দাবি, সেখান থেকেই দলটি বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে।
বিশ্লেষকদের একটি অংশ মনে করেন, ভারতের বারবার ‘অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন’-এর ওপর জোর দেওয়ার অর্থ হলো আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে ফিরিয়ে আনার ইঙ্গিত। আমেনা মহসিন বলেন, সাধারণভাবে দেখলে মনে হয়, ভারত নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে অন্তর্ভুক্ত করার কথাই বলছে।
অন্যদিকে আলতাফ পারভেজ মনে করেন, দীর্ঘদিনের প্রতিহিংসার রাজনীতি থেকে বেরিয়ে এসে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আনতে হলে সব দলের অংশগ্রহণ জরুরি। তবে যুক্তরাষ্ট্র এই কথা বললেও ভারতের ক্ষেত্রে এমন প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে, কারণ অতীতে ভারতের ভূমিকা নিরপেক্ষ ছিল না।
তার ভাষায়, ভারত সঠিক কথা বললেও মানুষ ধরে নিচ্ছে, আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে ফিরিয়ে আনাই লক্ষ্য।
ভারতের জাতীয় স্বার্থ ও অভ্যন্তরীণ হস্তক্ষেপ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক সাহাব এনাম খান মনে করেন, আওয়ামী লীগের সঙ্গে ভারতের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক দেশটির জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে জড়িত।
তিনি বলেন, ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের ভূমিকা এবং বাংলাদেশ সংক্রান্ত রাজনীতিতে বিজেপির আস্থার জায়গায় যে ঘাটতি তৈরি হয়েছে, তা পূরণ করতেই আওয়ামী লীগকে রাজনীতিতে পুনর্বাসনের চেষ্টা দেখা যাচ্ছে। এটি ভারতের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক অর্জন হিসেবেও বিবেচিত হতে পারে।
বিশ্লেষকদের মতে, শুধু নির্বাচন নয়—বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন বিষয়ে ভারতের ‘অযাচিত’ মন্তব্য ও গণমাধ্যমে বাংলাদেশবিরোধী বক্তব্যও এই তীব্র প্রতিক্রিয়ার একটি কারণ।
বিশেষ করে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোকে ‘উগ্রবাদী’ আখ্যা দেওয়ার প্রবণতা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে বলে মনে করেন সাহাব এনাম খান।
এছাড়া শেখ হাসিনার পতনের পর গত প্রায় ১৬ মাসে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক উন্নয়নে ভারতের পক্ষ থেকে তেমন আগ্রহ দেখা যায়নি বলেও মত বিশ্লেষকদের।
এই প্রেক্ষাপটে ভারতের পক্ষ থেকে বারবার নির্বাচন নিয়ে মন্তব্য করায় বাংলাদেশের তরফ থেকে এমন কঠোর প্রতিক্রিয়া এসেছে বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা।
