দলগুলোর মধ্যে ঘন ঘন বৈঠক
নির্বাচনী রাজনীতি: ভোটযুদ্ধের আগে জোটযুদ্ধ

হরলাল রায় সাগর
প্রকাশ: ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১০:৪২ পিএম

ছবি: সংগৃহীত
নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা কাটেনি। পরিস্থিতি ক্রমেই জটিল হচ্ছে। জুলাই সনদের ভিত্তিতে পিআর পদ্ধতিতে উভয়কক্ষে নির্বাচন, গণভোট, গণপরিষদ নির্বাচন হবে কিনা তা নিয়ে বিতর্ক চলছে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে। সমাধানে একদিকে টেবিলে আলোচনা, অন্যদিকে মাঠে আন্দোলনও চলছে। তাই বলে ভোটের প্রস্তুতিও থেমে নেই। এসবের মধ্যেই জাতীয় সংসদে ভোটযুদ্ধে অংশ নিতে মাঠ গোছানোর যুদ্ধে নেমেছে রাজনৈতিক দলগুলো। তবে অতীতের অভিজ্ঞতার আলোকে এবার এককভাবে নয়; জোটবদ্ধ হয়ে ভোটে অবতীর্ণ হতে চায় তারা। না হয় আসন সমঝোতা করে ভোটে অংশ নিতে পারে। আগে চারদলীয় জোটভুক্ত থাকলেও এসব ইস্যুতে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী এখন দুই মেরুতে।
নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে আলাদা জোট বাঁধছে ভাগাভাগি করে রাষ্ট্রক্ষমতা ভোগ করা দল দুটি। এ লক্ষ্যে বিভিন্ন দলের সঙ্গে আলোচনা করছে। আগের জোটে থাকা কিছু সমমনা দল এবং নতুন দল নিয়ে বড় জোট করতে পারে বিএনপি। তবে কোন ফরম্যাটে জোট হবে তার হিসাবনিকাশ করছে দলটি। আর জামায়াত দীর্ঘদিনের বৈরী চরমোনাই পীরের নেতৃত্বাধীন ইসলামী আন্দোলনসহ ধর্মভিত্তিক কয়েকটি দলের সঙ্গে জোট বাঁধতে পারে; ইতোমধ্যে তারা অভিন্ন কর্মসূচি দিয়ে আন্দোলনে নেমেছে। পাশাপাশি জাতীয় নাগরিক পার্টিরও (এনসিপি) জোট গঠনের সম্ভাবনা রয়েছে, তিনটি দল একসঙ্গে বিভিন্ন কর্মসূচিতে রয়েছে।
এছাড়া সিপিবিসহ বামপন্থি দলগুলোর একটি জোট এবং গণতন্ত্র মঞ্চসহ কয়েকটি দল মিলে আরেকটি জোট গঠনের গুঞ্জন রয়েছে। গণতন্ত্র মঞ্চের নেতৃত্বে একটি সভাও হয়েছে। এসব দলের জোট গঠনের বিষয়গুলো ইতোমধ্যে দৃশ্যমান হয়েছে। এছাড়া, জোট গঠনে পর্দার আড়ালেও চলছে নানা তৎপরতা। শীর্ষ নেতৃত্বের আলোচনার পাশাপাশি বিভিন্ন নীতিনির্ধারণী মহলে কৌশলে যোগযোগ চলছে। এমনকি আন্তর্জাতিক মহলেও জোট গঠনের প্রক্রিয়া নিয়ে তৎপরতার গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে জোট ও সমঝোতার বিষয়টি নতুন কিছু নয়। আগেও এমন ঘটনা দেখা গেছে। তবে এবার প্রেক্ষাপট ভিন্ন। দলের কার্যক্রম নিষিদ্ধ ও নিবন্ধন স্থগিত হওয়ায় দৃশ্যপটে নেই মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়া ও একাধিকবার রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। তাই ভোট ও মাঠের রাজনীতিতে বিএনপি এখন দেশের অপ্রতিদ্ব›দ্বী জায়গায় রয়েছে। আবার অপেক্ষাকৃত ভালো অবস্থানে আছে একসময়ের বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের অংশীদার ও মিত্রদল জামায়াতে ইসলামীও।
তবে এখন যা-ই করা হোক না কেন নির্বাচনের তফসিলের পর আনুষ্ঠানিকভাবে জোট কিংবা সমঝোতার বিষয়টি ঘোষণা করা হবে বলে আভাস মিলেছে। আগামী বছরের ফেব্রুয়ারি প্রথমার্ধে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছে সরকার। এমনকি নির্বাচনের কর্মপরিকল্পনাও (রোডম্যাপ) জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন। ডিসেম্বরের প্রথম দিকে তফসিল ঘোষণা হতে পারে বলেও জানিয়েছে সংস্থাটি। কিন্তু এই নির্বাচন কোন প্রক্রিয়ায় হবে তা এখনো চ‚ড়ান্ত করতে পারেনি অন্তর্বর্তী সরকার। সরকারের গঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশন জাতীয় (জুলাই) সনদের খসড়া তৈরি করেছে।
এতে অধ্যাদেশ, নির্বাহী আদেশ, গণভোট ও বিশেষ সাংবিধানিক আদেশ এই চার পদ্ধতিতে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করার পরামর্শ দিয়েছে বিশেষজ্ঞ প্যানেল। অন্য দিকে গণভোট, বিশেষ সাংবিধানিক আদেশ, গণপরিষদ গঠন করে প্রয়োজনীয় সাংবিধানিক ব্যবস্থা, ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচনে গঠিত সংসদের মাধ্যমে বাস্তবায়নসহ সংবিধান সংস্কার সভার সুপারিশ করেছে রাজনৈতিক দলগুলো। একই সঙ্গে নির্বাচনের আগেই জুলাই সনদের আইনি ভিত্তিও দাবি করে পিআর (সংখ্যানুপাতিক) পদ্ধতিতে সংসদের উচ্চকক্ষ ও নিম্নকক্ষে ভোটের দাবি জানিয়েছে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশসহ কয়েকটি দল।
ইতোমধ্যে জুলাই জাতীয় সনদের ভিত্তিতে আগামী ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন, জাতীয় সংসদের উভয়কক্ষে পিআর পদ্ধতিতে ভোট, সবার জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করা, ফ্যাসিস্ট সরকারের জুলুম নির্যাতন গণহত্যা ও দুর্নীতির বিচার দৃশ্যমান করা এবং স্বৈরাচারের দোসর জাতীয় পার্টি ও ১৪ দলের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার দাবিতে আন্দোলনে নেমেছে জামায়াতসহ ৭টি দল। জুলাই অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেয়া ছাত্রনেতাদের দল জাতীয় নাগরিক পার্টিও এর সব দাবির পক্ষে নয়, শুধু উচ্চকক্ষে পিআর পদ্ধতিতে ভোট এবং গণপরিষদ নির্বাচনের মত তাদের। ঠিক এর উল্টো পথে অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জাতয়িতাবাদী দল (বিএনপি)। দলটি সাফ জানিয়ে দিয়েছে পিআর পদ্ধতিতে ভোট নয়। জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি হবে নির্বাচিত সংসদে। এছাড়া কোনো রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধেওর পক্ষে নয় বলে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে বিএনপি।
বিএনপি ও জামায়াতের সঙ্গে মূলত দৃশ্যমান দ্বন্দ্ব এখান থেকেই। জামায়াত এবং অন্যান্য দলগুলোর যে আন্দোলন, দৃশ্যত সেটা সরকারের উদ্দেশ্যে হলেও এর মূল দ্ব›দ্ব মূলত বিএনপির সঙ্গে। ফলে আন্দোলনের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে বিএনপি। এছাড়া বিভিন্ন দলের মধ্যেও জুলাই সনদ নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে। এতে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়েও সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছে। সব পক্ষই ওই সময়ে ভোট চাইলেও বিএনপি অভিযোগ করেছে, ‘নির্বাচন বানচাল করার জন্যই জামায়াতসহ পক্ষটি পিআর পদ্ধতির অযৌক্তি বাহানা তুলেছে। টেবিলের আলোচনাও মাঠে নিয়ে গেছে।’
ফলে এই বিরোধ এখন নানা মত-পথের তৈরি করছে। আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে মূলত শক্ত অবস্থান গড়ে তুলতে চাইছে দুই পক্ষই। এ কারণে মিত্রতা ও বৈরিতা ভুলে এখন আলাদা জোটের দিকে হাঁটছে রাজনৈতিক দলগুলো। আপাতত কারা কার সঙ্গে জোট বাঁধছে তার একটি ধারণা রাজনৈতিক অঙ্গনে চাউর হচ্ছে। বিশ্লেষকদের মতে, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সফরসঙ্গী হিসেবে নিউইয়র্কে যাচ্ছেন বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপির গুরুত্বপূর্ণ চার নেতা। নির্বাচনকে সামনে রেখে তাদের এ সফর নানা ইঙ্গিত দিচ্ছে, যা তারা দেশে ফিরলে কর্মকাণ্ডে প্রতিফলিত হতে পারে। সার্বিক বিবেচনায় মনে হচ্ছে দলগুলোর মধ্যে যেসব ইস্যু নিয়ে এখন মতবিরোধ দেখা যাচ্ছে, তা দ্রুতই সমাধান হয়ে যেতে পারে।
বিএনপির জোট
বিএনপি নির্বাচনকেন্দ্রিক কোন ফরম্যাটে বা কাঠামোতে জোট করবে, তা নিয়ে এখন বিভিন্ন ফোরামে আলোচনা হচ্ছে। বিএনপির নেতৃত্বে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি), জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডি, নাগরিক ঐক্য, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, গণসংহতি আন্দোলন, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন, ভাসানী জনশক্তি পার্টি, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি), গণফোরাম, জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন (এনডিএম), জাতীয় পার্টি (কাজী জাফর) ১২ দলীয় জোট, ন্যাশনাল পিপলস পার্টির (এনপিপি) নেতৃত্বাধীন জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের ১১টি দল, গণতান্ত্রিক বাম ঐক্য ও বাংলাদেশ লেবার পার্টি জোট হতে পারে। এছাড়া জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ, ইসলামী আন্দোলনসহ কয়েকটি ইসলামি দলও বিএনপির সঙ্গে জোটে যুক্ত হতে পারে। এর মধ্যে কয়েকটি দল অরাজনৈতিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামেও যুক্ত। এছাড়া এনসিপি নেতাদের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে বিএনপির।
জামাতের জোট
জামায়াতসহ ইসলামপন্থি দলগুলোও বসে নেই। জামায়াত জোট কিংবা আসন সমঝোতা করে নির্বাচনে অংশ নেবে, এটা অনেকটা নিশ্চিত। ইতোমধ্যে জাতীয় সনদের ভিত্তিতে নির্বাচনসহ নানা দাবিতে জামায়াতসহ ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টি, খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন ও জাগপা অভিন্ন কর্মসূচি দিয়ে আন্দোলন করছে। তবে জামায়াত কাদের সঙ্গে জোট করছে তা নিশ্চিত নয়।
জামায়াতের সঙ্গে জোটের ব্যাপারে বেশ সক্রিয় চরমোনাই পীরের নেতৃত্বাধীন দল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। অতীতের বৈরিতা ভুলে দল দুটির মধ্যে বেশ সখ্য গড়ে উঠেছে। বিশেষ করে পিআর ইস্যুতে দল দুটি অভিন্ন সুরে কথা বলছে। এটা ঐক্যপ্রক্রিয়ায় প্রভাব ফেলতে পারে বলে ধারণা কারো কারো। অবশ্য ইসলামী আন্দোলনের চেয়ারম্যান সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করিম বলেছেন, ‘ইসলামী দলগুলোর ভোট এক বাক্সে নেয়ার প্রক্রিয়া চলছে।’ জোট গঠনের সরাসরি কথা না বলেও এতে বোঝা যায় জামায়াতের সঙ্গে জোটবদ্ধ হতে পারে তারা।
গণতন্ত্র মঞ্চের জোট
নাগরিক ঐক্য, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি), গণসংহতি আন্দোলন, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন ও ভাসানী জনশক্তিÑ এই ৬টি দল মিলে গণতন্ত্র মঞ্চ জোট আগেই বেঁধেছে। বেশ কিছু দিন ধরে জোট ঐক্যবদ্ধ কর্মসূচি দিয়ে আসছে। এই জোটটি পরিসর আরো বাড়াতে চায়। সমমনাদের নিয়ে তাদের জোট বড় হতে পারে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। একই সঙ্গে গণতন্ত্র মঞ্চ উদ্ভূত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সংস্কার নিয়ে বিএনপি ও জামায়াতের মতপার্থক্য দূর করতে তাদের সঙ্গে আলোচনায় বসার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। মঞ্চের সঙ্গে এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়েছে এনসিপি, আমার বাংলাদেশ পার্টি (এবি পার্টি) এবং গণঅধিকার পরিষদ। এই দল তিনটিও গণতন্ত্র মঞ্চের সঙ্গে জোটবদ্ধ হতে পারে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন শীর্ষ নেতারা।
এনসিপির জোট
জুলাই আন্দোলনের অন্যতম নেতা নাহিদ ইসলামের নেতৃত্বাধীন জাতীয় নাগরিক পার্টিও (এনসিপি) শেষ পর্যন্ত জোট গঠন করতে পারে। পাশাপাশি বিএনপির সঙ্গেও আসন সমঝোতাও হতে পারে বলে গুঞ্জন রয়েছে। জানা গেছে, এনসিপি জোট গঠন করলে তাতে এবি পার্টি, গণসংহতি আন্দোলন, গণঅধিকার পরিষদ, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনসহ আরো কয়েকটি দলকে দেখা যেতে পারে।
সিপিবির জোট
নির্বাচনের আগে বাম ধারার সব দল ও সংগঠনকে নিয়ে একটি জোট গঠনে তৎপর রয়েছে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)। এই জোটে বাম গণতান্ত্রিক জোটের ছয় দল-বাসদ, বাসদ (মার্কসবাদী), গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টি, সমাজতান্ত্রিক পার্টি ও বিপ্লবী কমিউনিস্ট লীগ থাকছে। এর বাইরে আদিবাসী সংগঠন, দলিত সংগঠন এবং নাগরিক সংগঠনগুলোকে জোটে ভেড়ানোর চেষ্টা চলছে। সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, আমরা রাজনৈতিক বন্দোবস্তের বদল চাই। বিগত সময়ে শাসক দলগুলোকে আমরা দেখেছি। তাই বিকল্প জোট গড়ে তোলার চেষ্টা করছি।