চব্বিশের শহীদরা প্রশ্ন রেখে গেছে—বাংলাদেশ তুমি কার?
প্রকাশ: ১৪ জুন ২০২৫, ০২:৪৩ এএম

রহমান মৃধা, গবেষক ও লেখক, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন
আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ’—সেই শিশুরাই একদিন রাষ্ট্রের হাল ধরে, বুক চিতিয়ে দেশপ্রেমে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তাদের ভেতরে দেশপ্রেম জাগ্রত হয় ছাত্রজীবন থেকেই, যার প্রমাণ আমরা বারবার পেয়েছি।
১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে গণআন্দোলনের অগ্রভাগে ছিলেন ছাত্ররাই। পাকিস্তানের শোষণ-শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের বীরত্বগাথা ছাত্রদেরই। পরে সর্বস্তরের জনতা আন্দোলনকে বেগবান করেছিলেন। সে আন্দোলনে শহীদ হয়েছিলেন ছাত্র আসাদুজ্জামান, মতিউর রহমান, শহীদ আমানুল্লাহ, ড. শামুজ্জামান জোহাসহ নাম না জানা আরও অনেকেই। তারা সেদিন অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন, জীবন বিলিয়ে দিয়েছিলেন দেশমাতৃকা রক্ষায়। তারা আজ ইতিহাসের পাতায় জ্বলজ্বল করছেন। পৃথিবীর ইতিহাসে বাংলাদেশ যতদিন থাকবে ততদিন এ শহীদদের মানুষ শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে।
এরপর এলো ’৭১-এর মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ। তখনো ছাত্ররাই নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তাদের নেতৃত্বে যুদ্ধ করেছিলেন কৃষক-শ্রমিক থেকে শুরু করে সাধারণ জনতা। লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে তারা ছিনিয়ে এনেছিলেন স্বাধীনতা। একাত্তরের যুদ্ধকে নিজেদের কুক্ষিগত করা আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে গ্রেপ্তার হন। কেউ বলেন তিনি আত্মসমর্পণ করেছিলেন। সে বিতর্কে নাইবা গেলাম। তিনি পাকিস্তানে বন্দি রইলেন। আর তার দলের প্রথম সারির নেতারা সব ভারতে পলায়ন করলেন। তার পরিবার পাকিস্তানিদের দেখভালে রাজার হালেই ছিল। তখন দিগভ্রান্ত এক জাতি। কেউ কল্পনাও করেননি ওই সময় একটি বাহিনীর মেজর জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়ে স্বাধীনতা ঘোষণা করে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়বেন। পাকিস্তানিদের অত্যাধুনিক অস্ত্রের সামনে শুধু বাঁশের লাঠি হাতে নিয়ে দেশমাতৃকার টানে হাজার হাজার ছাত্র-যুবক নিজের জীবনকে তুচ্ছজ্ঞান করে যুদ্ধ করেছেন। শহীদ জিয়া জাতিকে একটি স্বাধীন দেশ উপহার দিয়ে নিজে অন্তরালে চলে গিয়েছিলেন। সেই সাধারণ জনগণের ত্যাগ ছিনতাই করে ফেলল আওয়ামী লীগ—যে দলের সিনিয়র নেতারা ভারতে পালিয়ে ছিলেন, তারাই পরবর্তী সময়ে সরকার গঠন করে দেশটাকে গ্রাস করে ফেললেন। ব্যাংক ডাকাতি থেকে শুরু করে লুটপাট, চুরি, রাহাজানি, ছিনতাই—কী না আছে তাদের ঝুলিতে! আওয়ামী লীগ নিজস্ব বাহিনী তৈরি করে এক রামরাজত্ব কায়েম করেছিল। অন্য কোনো দল বা মানুষের কথা বলার কোনো অধিকারই ছিল না তখন। বৈষম্য মানুষ টের পেল হাড়ে হাড়ে। ত্যক্ত-বিরক্ত সাধারণ জনগণের ভেতরে ভেতরে ক্ষোভ দানা বাঁধতে লাগল। তারা এ থেকে অবসান চাইত, কিন্তু সাহস করে বলতে পারত না—যার ফলাফল দেশপ্রেমিক একদল সেনাবাহিনীর হাতে ১৫ আগস্টের মতো মর্মান্তিক ঘটনা। আবারও দেশ নেতৃত্বশূন্য, দেশের প্রয়োজনে আবার জনতা শহীদ জিয়াকেই অন্তরাল থেকে বের করে নিয়ে এলেন।
একটানা ৯ মাস যুদ্ধ করে আমরা একটি স্বাধীন দেশ পেয়েছি। এত অল্প সময়ে পৃথিবীতে মনে হয় না আর কোনো জাতিই এমন স্বাধীনতা পেয়েছে। স্বাধীনতার ঘোষক মহানায়ক মেজর জিয়াউর রহমান দেশ পুনর্গঠনের জন্য তৈরি করলেন বাংলাদেশ ন্যাশনাল পার্টি (বিএনপি)। তাকে দেশের সর্বস্তরের মানুষ সমর্থন দিলেন। শহীদ জিয়ার সততা ও বিচক্ষণ নেতৃত্ব মানুষকে আকর্ষিত করল। চারদিকে তার জয়জয়কার। তিনি অল্প কিছুদিনের মধ্যেই হয়ে উঠলেন অবিসংবাদিত নেতা। তিনি দেশ গড়তে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ছুটে চললেন। তার অক্লান্ত পরিশ্রম মানুষকে নাড়া দিল। মানুষের হৃদয়ের মণিকোঠায় তিনি অল্প সময়ের ব্যবধানে ঢুকে গেলেন। আজকের বিএনপি বেঁচে আছে শহীদ জিয়ার আদর্শেই। মানুষ সবসময় বিএনপিকে ন্যায়নীতিতেই দেখতে চায়। এ দেশের মানুষ প্রাণ উজাড় করে ভালোবাসে বিএনপিকে, ভালোবাসে শহীদ জিয়াকে। শহীদ জিয়ার দেখানো পথেই বেগম জিয়া হেঁটেছিলেন, যার ফলে তিনি তিনবার প্রধানমন্ত্রী হন, বনে যান এ দেশের অপ্রতিদ্বন্দ্বী এক নেত্রীতে, যার ধারেকাছেও আর কোনো দিন কেউ যেতে পারবে কি না সন্দেহ আছে। সেই দলটির কাছে মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা অনেক বেশি। ১৯৭৮ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত বিএনপির জনপ্রিয়তা একবিন্দুও কমেনি। আর বিএনপির ভরসাও সেই সাধারণ জনগণই। আজকে মানুষ সেই আদর্শিক বিএনপিকেই দেখতে চায়। সেখান থেকে বিচ্যুত হলে মানুষ বুকে কষ্ট চেপে হয়তো মুখ ফিরিয়ে নেবে। এ বাস্তবতা বিএনপি যত তাড়াতাড়ি বুঝবে ততই তাদের জন্য মঙ্গল।
সর্বশেষ চব্বিশের আন্দোলনেও ছাত্ররাই ছিল অগ্রভাগে। মূলত ছাত্রদের নেতৃত্বেই সাধারণ জনগণ মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে আন্দোলনকে বেগবান করেছে। আহা! আবু সাঈদ-মুগ্ধদের হাসিমুখে প্রাণ বিলিয়ে দেওয়া এ এক জ্বলন্ত ইতিহাস! দিনের আলোয় কীভাবে তাদের বুক ঝাঁঝরা করে দেওয়া হলো! ছোট বাচ্চাগুলোর এ কেমন টান দেশের প্রতি! সত্যি স্যালুট চব্বিশের শহীদদের প্রতি। তোমরা এ জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। তোমাদের অবদান কি ভোলা যায়! ইতিহাসের পাতায় তোমাদের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা রবে। হাসিমুখে প্রাণ বিলিয়ে দেওয়া ছেলেগুলোকে কীভাবে মূল্যায়ন করবে এ জাতি! কিন্তু এ আন্দোলন এক দিনে তৈরি হয়নি। ১৭ বছরের স্বৈরাচার শেখ হাসিনার প্রতি মানুষের ক্ষোভ আর ঘৃণা পুঞ্জীভূত হয়ে দাবানলের মতো বিস্ফোরিত হয়েছে। ১৭ বছর বিএনপি বিশেষ করে জামায়াত হারিয়েছে তাদের দলের তরতাজা বহু প্রাণ। শেখ হাসিনা বিরোধী দলশূন্য একটা রাষ্ট্র কায়েম করতে চেয়েছিলেন। তাই তো যত গুম-খুন, ঘরছাড়া ও দেশছাড়া হয়েছে বিএনপি-জামায়াতের সদস্যরা। জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের অন্যায়ভাবে ফাঁসি, লগি-বৈঠা দিয়ে নেতাকর্মীদের পিটিয়ে হত্যা—কী না করেছে স্বৈরাচার হাসিনা সরকার? খালেদা জিয়াকে গৃহহারা করা, মিথ্যা মামলা দিয়ে জেলে পোরা, তারেক জিয়াকে নির্যাতন করে মৃত্যুর দুয়ারে নিয়ে যাওয়া—এত এত নির্যাতন করে হাসিনা জিয়া পরিবারকে জনপ্রিয়তা শীর্ষ চূড়ায় উঠিয়ে দিয়েছে। কিন্তু এখন যখন দেখি সেই জামায়াত-বিএনপির মধ্যে বিভাজন, সত্যি মন খারাপ হয়। এই জামায়াতের সঙ্গে জোটে থাকার জন্য বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা শহীদ জিয়াকে ‘রাজাকার, পাকিস্তানের চর’ বলতেও হাসিনা দ্বিধা করেননি।
তাই ঘটনার বাস্তবতায় যেটা বলতে হয় তা হলো, চব্বিশের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ছাত্ররা মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে বুক পেতে দিয়ে হাসিনাকে দেশছাড়া করেছে। তার ফল পেতে হলে একটা গণতান্ত্রিক সরকার দরকার। ফিরিয়ে আনা দরকার ভোটের অধিকার, কিন্তু গণহত্যাকারীদের বিচার এ সরকারকেই করতে হবে। আর সে সুযোগ রাজনৈতিক দলগুলোকেও দেওয়া দরকার। সংস্কার একটা চলমান প্রক্রিয়া, যেটা চলতেই থাকবে। যতটুকু সম্ভব সংস্কার করে সরকারকে একটা সুষ্ঠু নির্বাচন দিতে হবে, তবেই চব্বিশের শহীদদের জীবনদান সার্থক হবে। আমি মনে করি, রাজনীতিতে না জড়িয়ে ছাত্রদের দেখা উচিত সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে যে সরকারই আসুক তারা ঠিকমতো দেশ চালাচ্ছে, নাকি দুর্নীতি করছে। অতন্দ্র প্রহরীর মতো রাষ্ট্রকে পাহারা দেওয়াই ছাত্রদের এখন একমাত্র কর্ম হওয়া দরকার। সময়ের ব্যবধানে জাতি হয়তো এই বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের খুঁজে বের করে দেশের হাল ধরার দায়িত্ব দেবে। এর অন্যথা হলে আবু সাঈদ-মুগ্ধরা ক্ষমা করবে না এ জাতিকে।
একটি জাতির ভাগ্য বদলে দেয় আত্মত্যাগ, কিন্তু সেই আত্মত্যাগ যদি সঠিক পথে পরিচালিত না হয়, তবে তা শুধু ইতিহাসের পাতায় রক্তের দাগ হয়ে থেকে যায়। চব্বিশের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনে যারা প্রাণ দিয়েছিল—আবু সাঈদ, মুগ্ধ, আর অসংখ্য নাম না-জানা তরুণ—তাদের আত্মদান ছিল কোনো দল বা গোষ্ঠীর পক্ষে নয়, ছিল একটি রাষ্ট্রচিন্তার পক্ষে।
তারা চেয়েছিল এমন একটি বাংলাদেশ, যেখানে বৈষম্য থাকবে না, গুম-খুন-দমন থাকবে না, থাকবে ভোটের অধিকার, ন্যায়বিচার আর প্রশ্নহীন দেশপ্রেম। এই ছাত্ররা জানত, শেখ হাসিনার পতনে কোনো অলৌকিক রূপান্তর আসবে না, যদি না আমরা নিজেরাই নতুন কিছু নির্মাণ করি। এই নতুন নির্মাণের জন্য জরুরি—একটি গভীর, নিরপেক্ষ, নির্মোহ আত্মসমালোচনা। বিএনপি যদি আবার দায়িত্ব পায়, তাহলে তাকে শুধু অতীতের গৌরব নয়, বর্তমানের দায়ও কাঁধে নিতে হবে। কারণ শেখ হাসিনাকে সরিয়ে দিয়েই যদি পুরনো ভুলে ফিরে যাই, তাহলে চব্বিশের শহীদরা আমাদের ক্ষমা করবে না।
একটি জিনিস ইতিহাস প্রমাণ করে দিয়েছে—ছাত্ররা রাষ্ট্র পরিচালনা করে না, কিন্তু তারা রাষ্ট্রের বিবেক জাগিয়ে তোলে। এখন সময় এসেছে ছাত্রদের নতুন ভূমিকার—কোনো দলের ছত্রছায়ায় নয়, বরং রাষ্ট্রের অঘোষিত বিবেক হিসেবে দাঁড়ানোর।
আজকের ছাত্রদের একটাই পরিচয়—তারা রক্ত দিয়ে প্রশ্ন করেছে এই রাষ্ট্রকে। তাদের প্রশ্নের জবাব সরকারকে দিতে হবে। শুধু উন্নয়ন নয়, দিতে হবে মানবিকতা, গণতন্ত্র, জবাবদিহিতার গ্যারান্টি।
আজ প্রশ্ন উঠেছে—চব্বিশের শহীদদের আত্মত্যাগ কি সফল হবে?
এই সফলতা নির্ভর করছে তিনটি বিষয়ের ওপর:
১. বিএনপি ও অন্য বিরোধীদলগুলোর সত্যিকারের সংস্কার—যেখানে আদর্শকে সামনে রেখে পেছনে রাখা হবে ক্ষমতার মোহ।
২. একটি সুষ্ঠু নির্বাচন—যেন মানুষ ভয়হীনভাবে নিজের সরকার বেছে নিতে পারে।
৩. ছাত্রদের দূরদর্শী ভূমিকা—তারা শুধু আন্দোলন নয়, দেশের ভবিষ্যতের কাঠামো নির্ধারণেও ভূমিকা নিক।
একটি আদর্শ রাষ্ট্র এমন, যেখানে শহীদদের নাম শুধু দেয়ালে নয়, রাষ্ট্রচর্চার প্রতিটি স্তরে লেখা থাকে। আবু সাঈদ-মুগ্ধদের মৃত্যু শুধু প্রতিবাদ নয়—সেটা একটি ঐতিহাসিক ওয়াদা, যা আমরা ভাঙতে পারি না। তারা হাসিমুখে বলেছে, "তোমরা যদি দেশটাকে বদলাতে না পারো, তবে আমাদের আত্মদান বৃথা।" আজ, যখন আমরা তাদের কবরের পাশে দাঁড়িয়ে নীরবে ভাবি—তখন মনে হয়, প্রশ্নটা এখন আর শহীদদের নয়, প্রশ্নটা আমাদের: বাংলাদেশ, তুমি কার জাগ্রত জনতা? তুমি কি শুধুই স্মরণে বাঁচবে, নাকি দায়িত্বে জাগবে?
রহমান মৃধা, গবেষক ও লেখক, (সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন), [email protected]