নির্বাচনের আগে একটি নতুন বাংলাদেশের আশা ও হতাশা
প্রকাশ: ০৯ অক্টোবর ২০২৫, ০৭:২৯ এএম

নতুন বাংলাদেশ। ছবি: ভোরের কাগজ
বাংলাদেশের জন্মলগ্নে আনন্দ এবং বিষাদ ছিল তাঁর জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। একদিকে লাখো মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল, তেমনি বিনিময়ে আমরা পেয়েছিলাম একটি বাংলাদেশ যেখানে শপথ ছিল সোনার বাংলাদেশ গড়ার। “প্রথম বাংলাদেশ আমার শেষ বাংলাদেশ, জীবন বাংলাদেশ আমার মরণ বাংলাদেশ” এই অঙ্গীকার নিয়েই আমরা এগিয়েছিলাম, বাকি সব ইতিহাস।
২৪-এর ৫ অগাস্ট আবারও নতুন প্রজন্ম নেতৃত্ব দিয়েছে, স্বৈরাচারী সরকারের পতন ঘটিয়ে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনে। কিন্তু সেই বাংলাদেশ, যে স্বপ্ন পূরণের পথে যাত্রা শুরু করেছিল, আজ আবারও বিভ্রান্তি ও হতাশার অন্ধকারে।
আমার কষ্ট এখানেই কারণ ভেবেছিলাম ড. ইউনুসের নেতৃত্বে আমরা সত্যিই নতুন বাংলাদেশ গড়তে পারব। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। বিচারপতি থেকে রাষ্ট্রপতি, সেনাপ্রধান থেকে পুলিশ প্রধান প্রশাসন ও রাজনৈতিক দলগুলো দুর্নীতির ছত্রছায়ায় আবৃত। একটি রাষ্ট্র কীভাবে টিকে থাকবে, যখন তার শীর্ষস্তরই দুর্নীতিতে জর্জরিত?
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার পর এত মাস পেরিয়ে গেলেও প্রকৃত অপরাধীদের বিচার হয়নি। রাষ্ট্রপতি, সেনাপ্রধান, পুলিশ প্রধান, প্রধান বিচারপতি এদের মধ্যে অনেকে অতীতে ক্ষমতার অপব্যবহার, দমননীতি এবং মানবাধিকারের লঙ্ঘনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। অথচ শুধু শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে অন্যদের দায় এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে। এতে ন্যায়বিচার ও জবাবদিহি প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে।
আরও উদ্বেগজনক হলো, যেসব ব্যক্তি বা গোষ্ঠী শেখ হাসিনাকে নিরাপদে দেশ ত্যাগে সহায়তা করেছে, তাদের বিরুদ্ধেও কোনো তদন্ত বা ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। যারা তিনবার ভোট ডাকাতির মাধ্যমে জনগণের ভোটাধিকার কেড়ে নিয়ে স্বৈরাচার প্রতিষ্ঠা করেছে, তারা আজও প্রশাসনের উচ্চপদে থেকে প্রভাব খাটাচ্ছে।
রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদে থেকে যারা হাজার মানুষের জীবন, স্বাধীনতা ও ন্যায়ের অধিকার ধ্বংস করেছে — ঘুমন্ত মানুষকে তুলে নিয়ে গেছে, খুন করেছে, গুম করেছে — সেই সব ব্যক্তিরা আজও দায়মুক্ত অবস্থায় আছে। প্রশ্ন হলো, কীভাবে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে তারা এখনও দায়িত্ব পালন করতে পারে, যখন তাদের বিরুদ্ধে জাতির প্রতি গুরুতর অপরাধের অভিযোগ রয়েছে?
সত্য কথা বলা এখন বাংলাদেশে দুষ্কর। ভয়, স্বার্থ আর নীরবতার সংস্কৃতি জাতিকে দিশাহীন করেছে। কিন্তু আমি পথভ্রষ্ট হইনি। চার দশকেরও বেশি সময় ধরে দেশের জন্য কাজ করেছি, রেমিট্যান্স পাঠিয়ে অর্থনীতিতে অবদান রেখেছি, দুর্নীতির সাথে কখনো যুক্ত হইনি। তাই সত্য বলার দায় আমার আছে।
এখন প্রয়োজন, নির্ভিকভাবে এবং প্রমাণের ভিত্তিতে, সব স্তরের অপরাধীদের বিরুদ্ধে তদন্ত ও ব্যবস্থা গ্রহণ করা— তা সে যে পদেই থাকুক না কেন।
পাঁচটি পদক্ষেপ এখনই জরুরি:
১. ৩০ দিনের মধ্যে একটি স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠন করতে হবে, যেখানে প্রাক্তন ও বর্তমান প্রশাসনের শীর্ষপদস্থদের সম্পদ, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং দায় নিরূপণ করা হবে।
২. শেখ হাসিনাকে সেফ এক্সিটে সহায়তাকারী এবং তিনবার ভোট ডাকাতির মাধ্যমে স্বৈরাচার প্রতিষ্ঠায় যুক্ত ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে তদন্তের আওতায় আনতে হবে।
৩. রাষ্ট্রপতি, সেনাপ্রধান, পুলিশ প্রধান, প্রধান বিচারপতি — এদের ভূমিকা ও সিদ্ধান্তের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে, যেখানে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ রয়েছে।
৪. ৯০ দিনের মধ্যে দায়-প্রমাণিত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা ও পদচ্যুতি নিশ্চিত করতে হবে।
৫. গণমাধ্যম, নাগরিক সমাজ ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর তত্ত্বাবধানে স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় এই বিচার কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে।
এটি এখন সময়ের দাবি। যদি আজও মূল অপরাধীদের বিচার না হয়, তাহলে আগামী প্রজন্ম আবারও একই অন্ধকারে নিমজ্জিত হবে। ইতিহাস নিজেকে পুনরাবৃত্তি করবে—আর তখন হয়তো আর কিছুই করার থাকবে না।
আমি চাই এই বার্তাটি দেশ ও বিশ্বের মানুষ জানুক — বাংলাদেশে আজও এমন মানুষ আছে যারা সত্যের পক্ষে দাঁড়ায়, যারা দেশপ্রেমকে ব্যক্তি স্বার্থের ঊর্ধ্বে রাখে।
রহমান মৃধা, গবেষক ও লেখক, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন, [email protected]