ক্ষুধা একটি রাজনৈতিক পছন্দের ফল

আল-জাজিরা অবলম্বনে বিপ্লব বণিক
প্রকাশ: ১৬ অক্টোবর ২০২৫, ০১:০৯ পিএম

ছবি : সংগৃহীত
রাষ্ট্রগুলো ক্ষুধা নিরসনে পদক্ষেপ নিতে পারে এবং অবশ্যই নেয়া উচিত। ক্ষুধা কোনো প্রাকৃতিক অবস্থা বা অনিবার্য ট্র্যাজেডি নয়; এটি হলো সরকার এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পছন্দের ফল, যা বৈষম্যের প্রতি চোখ ফেরাতে বা সেগুলোকে প্রশ্রয় দিতে বেছে নিয়েছে। যে বৈশ্বিক ব্যবস্থা ৬৭৩ মিলিয়ন মানুষের পর্যাপ্ত খাদ্যের অধিকার অস্বীকার করে, সেই একই ব্যবস্থা মাত্র ৩,০০০ বিলিয়নেয়ারের একটি বিশেষ গোষ্ঠীকে বৈশ্বিক মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১৪.৬ শতাংশের মালিকানা ধরে রাখতে সক্ষম করে। এই চরম বৈষম্য প্রমাণ করে যে, মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য সম্পদের অভাব নেই, অভাব রয়েছে ন্যায়সঙ্গত বণ্টন এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছার।
২০২৪ সালে, ধনী রাষ্ট্রগুলো স্নায়ুযুদ্ধের সমাপ্তির পর সামরিক ব্যয়ে বৃহত্তম উল্লম্ফন ঘটাতে সাহায্য করেছিল, যা সে বছর $২.৭ ট্রিলিয়নে পৌঁছেছিল। অন্যদিকে, দরিদ্র দেশগুলোতে উন্নয়নের প্রচারের জন্য তাদের জিডিপি-র ০.৭ শতাংশ বিনিয়োগ করার নিজস্ব প্রতিশ্রুতি পূরণে তারা ব্যর্থ হয়েছে। সামরিক খাতে এই বিপুল ব্যয় এবং উন্নয়ন সহায়তার প্রতি উদাসীনতা বৈশ্বিক অগ্রাধিকারের ক্ষেত্রে এক গভীর নৈতিক সংকটকে তুলে ধরে।
আজ, আমরা এমন পরিস্থিতিতে বসবাস করছি যা ৮০ বছর আগে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা তৈরির সময় বিরাজমান পরিস্থিতির চেয়ে ভিন্ন নয়। তবে, তখন যা ছিল না, তা হলো- আমরা শুধু যুদ্ধ ও ক্ষুধার ট্র্যাজেডি একে অপরের ইন্ধন যোগানো দেখছি না, বরং জরুরি জলবায়ু সংকটেরও মুখোমুখি হচ্ছি। ১৯৪৫ সালের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা আজকের বহুমাত্রিক সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য আর যথেষ্ট নয়। বৈশ্বিক শাসন ব্যবস্থার সংস্কার এখন অপরিহার্য। বহুপক্ষীয়তা জোরদার করা, টেকসই উন্নয়নকে উৎসাহিত করে এমন বিনিয়োগ প্রবাহ তৈরি করা এবং রাষ্ট্রগুলোর ক্ষুধা ও দারিদ্র্য মোকাবিলায় সুসংহত জননীতি বাস্তবায়নের ক্ষমতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
এই পরিবর্তন শুরু করার জন্য জনসাধারণের বাজেটে দরিদ্রদের এবং করের ভিত্তির মধ্যে ধনীদের অন্তর্ভুক্ত করা অপরিহার্য। এর জন্য প্রয়োজন কর ন্যায়বিচার এবং অতি-ধনীদের ওপর কর আরোপ, যা বৈষম্য কমাতে কার্যকর ভূমিকা রাখে। ব্রাজিলের প্রেসিডেন্সির অধীনে ২০২৪ সালের নভেম্বরে অনুষ্ঠিত এ২০ সম্মেলনের চূড়ান্ত ঘোষণাপত্রে প্রথমবারের মতো এই বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা ছিল একটি প্রতীকী কিন্তু ঐতিহাসিক পরিবর্তন। ব্রাজিল এই অনুশীলনের পক্ষে কথা বলছে এবং অভ্যন্তরীণভাবে তা বাস্তবায়ন করছে। দেশটির পার্লামেন্ট একটি উল্লেখযোগ্য কর সংস্কার অনুমোদন করতে চলেছে, যেখানে দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো, কোটিপতিদের আয়ের উপর ন্যূনতম কর থাকবে, যা লাখ লাখ কম আয়ের উপার্জনকারীকে আয়কর দেয়া থেকে অব্যাহতি দেবে।
ব্রাজিল তার জি২০ প্রেসিডেন্সির সময় ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে বৈশ্বিক জোটও (গ্লোবাল এলিয়েন্স এগিনেস্ট হাংগার এন্ড প্রোভার্টি) প্রস্তাব করেছিল। এই উদ্যোগে ইতোমধ্যে ২০০ সদস্য রয়েছে, ১০৩টি দেশ এবং ৯৭টি অংশীদার ফাউন্ডেশন ও সংস্থা। এই জোটটি কেবল অভিজ্ঞতা বিনিময়ের জন্য নয়, বরং সম্পদ একত্রিত করা এবং প্রতিশ্রুতি সুরক্ষিত করার জন্য কাজ করবে। এই জোটের মাধ্যমে, দেশগুলোকে এমন জননীতি বাস্তবায়ন করতে সক্ষম করা হবে যা সত্যিই বৈষম্য হ্রাস করে এবং পর্যাপ্ত খাদ্যের অধিকার নিশ্চিত করে। ব্রাজিলের অভিজ্ঞতা এই উদ্যোগের ভিত্তি। যখন দেশটি ২০২৩ সালে ক্ষুধার বিরুদ্ধে লড়াইকে সরকারি অগ্রাধিকার দিয়েছিল, তখন দ্রুত ফলাফল এসেছিল।
মাত্র কয়েক দিন আগে প্রকাশিত সরকারি তথ্যে দেখা যায় যে, ২০২৩ সালের শুরু থেকে ২৬.৫ মিলিয়ন ব্রাজিলিয়ানকে ক্ষুধা থেকে তুলে আনা হয়েছে। উপরন্তু, খাদ্য নিরাপত্তার ওপর এফএও-এর বৈশ্বিক প্রতিবেদনে যেমন উল্লেখ করা হয়েছে, ব্রাজিলকে দ্বিতীয়বারের জন্য এফএও-এর ক্ষুধা মানচিত্র থেকে সরানো হয়েছে। এই অর্জনগুলোর পিছনে রয়েছে একাধিক ফ্রন্টে সমন্বিত পদক্ষেপ। ব্রাজিল জাতীয় আয় স্থানান্তর কর্মসূচিকে শক্তিশালী ও প্রসারিত করেছে, যা এখন ২০ মিলিয়ন পরিবারে পৌঁছায় এবং ছয় বছর বা তার কম বয়সী ৮.৫ মিলিয়ন শিশুকে সহায়তা করে। সরকারি স্কুলগুলোতে বিনামূল্যে খাবারের জন্য তহবিল বাড়ানো হয়েছে, যার ফলে ৪০ মিলিয়ন শিক্ষার্থী উপকৃত হচ্ছে। সরকারি খাদ্য সংগ্রহের মাধ্যমে ক্ষুদ্র পারিবারিক কৃষকদের জন্য আয় সুরক্ষিত করা হয়েছে এবং একই সঙ্গে যাদের সত্যিকার অর্থে প্রয়োজন তাদের বিনামূল্যে পুষ্টিকর খাবার সরবরাহ করা হচ্ছে। এছাড়াও, কম আয়ের পরিবারগুলোতে রান্না গ্যাস এবং বিদ্যুতের বিনামূল্যে সরবরাহ বাড়ানো হয়েছে।
তবে, এই নীতিগুলোর কোনোটিই এমন একটি অর্থনৈতিক পরিবেশ ছাড়া টেকসই নয় যা সেগুলোকে চালিত করে। যখন চাকরি এবং আয় থাকে, তখন ক্ষুধার কবল শিথিল হয়। এই কারণেই ব্রাজিল এমন একটি অর্থনৈতিক নীতি গ্রহণ করেছে যা মজুরি বৃদ্ধিকে অগ্রাধিকার দেয়, যার ফলে ব্রাজিলে রেকর্ড করা সর্বনিম্ন বেকারত্বের হার তৈরি হয়েছে এবং মাথাপিছু পারিবারিক আয়ের বৈষম্যের সর্বনিম্ন স্তর তৈরি হয়েছে।
ব্রাজিল তার সমস্ত জনসংখ্যার জন্য সম্পূর্ণ খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনের আগে এখনো অনেক দূর যেতে হবে, কিন্তু ফলাফল নিশ্চিত করে যে রাষ্ট্রের সমন্বিত পদক্ষেপ সত্যিই ক্ষুধার অভিশাপকে কাটিয়ে উঠতে পারে। তবে, এই উদ্যোগগুলো বৈশ্বিক অগ্রাধিকারগুলোতে সুস্পষ্ট পরিবর্তনের ওপর নির্ভর করে, যুদ্ধের পরিবর্তে উন্নয়নে বিনিয়োগ; কয়েক দশক ধরে সম্পদের ব্যাপক কেন্দ্রীভবনের কারণ হওয়া বিধিনিষেধমূলক অর্থনৈতিক নীতির পরিবর্তে বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াইকে অগ্রাধিকার দেয়া; এবং মানুষকে কেন্দ্রে রেখে জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা।
আগামী মাসে অ্যামাজনে সিওপি৩০ আয়োজনের মাধ্যমে, ব্রাজিল দেখাতে চায় যে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াই এবং ক্ষুধার বিরুদ্ধে লড়াই অবশ্যই হাতে হাত রেখে চলতে হবে। বেলেমে, ব্রাজিল ক্ষুধা, দারিদ্র্য এবং জলবায়ুর ওপর একটি ঘোষণা গ্রহণ করার লক্ষ্য রাখে যা জলবায়ু পরিবর্তনের গভীর অসম প্রভাব এবং বিশ্বের নির্দিষ্ট অঞ্চলে ক্ষুধা আরো বাড়িয়ে তোলার ক্ষেত্রে এর ভূমিকাকে স্বীকার করে। এই বার্তাগুলো দেখায় যে পরিবর্তন জরুরি এবং সম্ভব। কারণ মানবতা, যা নিজের বিরুদ্ধে ক্ষুধার বিষ তৈরি করেছে, তা এর প্রতিষেধকও তৈরি করতে সক্ষম।
মূল লেখা : লুইজ ইনাসিও লুলা দা সিলভা : ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট