×

পূজা বিশেষ : শারদ দিনের প্রীতি সম্ভাষণ

দুর্গা নামের মেয়েটি

অজয় দাশগুপ্ত

Icon

প্রকাশ: ১১ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

দুর্গা নামের মেয়েটি
   

বছরে সে একবার আসে বাপের বাড়ি। তার এই আগমনের কাল বা ঋতুটি বড় সুন্দর। বাংলা ও বাঙালির জীবনে এখন আর ষড়ঋতু নেই বললেই চলে। বাংলাদেশে মূলত গ্রীষ্ম, বর্ষা, অল্প শীত- এই তিন ঋতু ভিন্ন বাকিগুলো আছে কি, নাই বোঝা মুশকিল। কিন্তু তার আগমনের কালটি ছোট-বড় যাই হোক, মনোরম ও অসাধারণ। কাশবনে শুভ্রতার হাতছানি। যা দেখে রবীন্দ্রনাথও লিখেছিলেন, একধারে কাশবন ফুলে ফুলে সাদা। অপূর্ব এই শরৎকাল আমাদের গানে, কবিতায় ও প্রকৃতিতে বিরাজমান।

শরৎ তোমার অরুণ আলোর অঞ্জলি- এই একটি পঙক্তি মনে করিয়ে দেয় কতটা মনোরম এই ঋতু। অরুণ তার আলোর অঞ্জলি নিয়ে ডালি নিয়ে আসে শরতে। যারা গান শোনেন তারা জানেন, আমার রাত পোহালো শারদ প্রাতে গানটি কেমন মর্মভেদী। যেখানে কবিগুরু বারবার আকুতি করছেন, বাঁশি তোমায় দিয়ে যাব কাহার হাতে বলে। এই আকুতি এই শিউলি ফোটা ভোর এই সকালের শিশির সব মিলিয়ে বাঙালি জানে তার একটি উৎসব সমাগত। কী আশ্চর্য! সুন্দর এই উৎসব। বাঙালির মেয়েরা বিয়ের পর খুব মুশকিলে পড়ে যেত। যেত বললাম এই কারণে, এখন এসব বিষয়ে আইনি মীমাংসা আছে। অথচ একসময় বিয়ে হয়ে যাওয়া মানেই সে মেয়েটির ঠিকানা অন্য কারো হয়ে যাওয়া। যেখানে তার জন্ম, বড় হয়ে ওঠা যে পরিবারের অনিবার্য অংশ ছিল, সেটি হয়ে ওঠে তার বাপের বাড়ি। সে আর সেখানে থাকে না থাকতে পারে না। বেড়াতে যায় নাইওর যায়। আর যেখানে সে থাকে তার নাম স্বামীর বাড়ি। এই ঠিকানাহীন নারীকুলের বাঙালিদের ভেতর এই মেয়েটি ব্যতিক্রম।

সে আসে তার দুই ছেলে দুই মেয়ে নিয়ে। যারা নিজেরাও একেকজন কিংবদন্তি। যাদের কারো কাছে শিল্পকলা, সাহিত্য সব নতজানু। কারো পায়ে গড়াগড়ি খায় ধন-সম্পদ। ছেলেদের একজন বিশ্বজয়ী বীর, আরেকজন বিঘœ নাশক। স্বামীও এক দিকপাল। বাঙালি হিন্দুর আরাধ্য দেবাতদের ভেতর ইনি দেবাদিদেব নামে পরিচিত। যিনি আপাদমস্তক একজন পতœীঘনিষ্ঠ দেবতা। অন্য দেবতারা এমন কি দেবরাজ নামে পরিচিত ইন্দ্রও যখন একটার পর একটা বিয়ে করেন, বৌ বদলান ইনি তখন স্ত্রীর অপমানে বিশ্ব সংসার কাঁপিয়ে দিয়েছেন। পার্বতীকেও একা ছাড়েননি তিনি। নিজেও আসেন সঙ্গে।

এই মেয়েটি আসা মানেই বাঙালির অন্তরে শিল্পকলা সৌন্দর্য আর ভালোবাসা জাগ্রত হওয়া। কেমন এক মায়া। আসবে বলে মৃৎশিল্পী নামে পরিচিতদের হাতের জাদুতে জাগ্রত হতে থাকে মহামায়া। কত যতœ আর ভালোবাসায় নির্মাণ হতে থাকে মুখাবয়ব। খেয়াল করে দেখবেন, প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে এত মূর্তি এতবার করে সাজানো অথচ কোনোটি কোনোটির সঙ্গে হুবহু মেলে না। কোনো বছর মেলেনি। এ এক অদ্ভুত রহস্য।

বলছিলাম, মেয়েটি আসবে বলে কত আগে থেকেই ঢাকে কাঠি পড়ে। শোনা যায়, তার মৃদু-মন্দ বা গুরুগম্ভীর আওয়াজ। সাড়া জাগে মানুষের শিল্পবোধে। সে কবে থেকে শারদ সংখ্যার ভেতর দিয়ে সাহিত্য-সংস্কৃতিতে নতুন লেখা, নতুন পাঠ আচ্ছন্ন করে রেখেছে আমাদের। সুনীল, শক্তি, শীর্ষেন্দু, মুস্তফা ও সিরাজ বা তার আগেও আমরা সমরেশ বসু, শংকরদের কাছে হাত পেতে থাকতাম শারদীয় সংখ্যার লেখা পাবো বলে। আজকে বাংলাদেশেও এমন সংখ্যা প্রকাশ হয়। আমাদের দেশের বাঙালিদের উৎসবের আমেজ একটু বেশি। নতুন জামা-কাপড়, নতুন পরিচ্ছদ নবীন জীবনের জন্য প্রার্থনার পাশাপাশি এখন ইলিশ মাছও ঢুকে গেছে এই প্রক্রিয়ায়। দুই বাংলার সম্পর্কের জায়গাটিতেও প্রভাব ফেলছে পদ্মার ইলিশ। যার নাম রাজনীতি।

এ কথাটাই বলতে চাচ্ছিলাম। এই রাজনীতির সঙ্গে তার আসার কোনো যোগ নেই, ছিলও না। কিন্তু সে কবে থেকে রাজনীতি তাকে আঁকড়ে ধরে রেখেছে। কলকাতার আকাশবাণীতে যখন মহালয়া হয়, তখনো এই রাজনীতি আক্রমণ করেছিল। বাদ্যযন্ত্রীদের মধ্যে যারা অহিন্দু, তাদের নিয়ে ঝড় তুলেছিল কুলীন নামে পরিচিতজনরা। এমনকি মহালয়া খ্যাত প্রবাদ প্রতিম বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রকে নিয়েও চলেছিল রাজনীতি। তিনি চন্ডিপাঠ করলে, তা শুদ্ধ হবে কিনা- এই ছিল তর্ক। কারণ বীরেন বাবু তো কুলীন নন।

কাল পালটেছে। আমাদের দেশে তার আসার সঙ্গে আরেক ধরনের রাজনীতি যুক্ত হয়ে গেছে। সে বাপের বাড়ি পৌঁছানোর আগেই শুরু হবে যায় মারামারি। মূর্তি ভাঙ্গার হিড়িক। সত্যি এই এই ভাঙা মূর্তিগুলো এখন তার আগমনের স্মারক। এটি কেবল আমাদের নয়, দেশ ও জাতির জন্য লজ্জার বিষয়। আজকাল আরেকটি বিষয় জড়িত হয়েছে, যার নাম পাহারা। আমার কাছে এটি অত্যন্ত বেদনার। নির্মম উপহাসের মতো। আমার দেশ আমার মাটি আমার জন্মভূমিতে আমার কন্যারূপী দেবীকে পাহারায় রাখতে হবে কেন? আমার কন্যা মাদের মা তো অন্যদের অতিথি। মেহমান কি পাহারায় থাকে? না তাকে পাহারা দেয়াটা ভদ্রতা?

এসব কথার উত্তর মিলবে না। কারণ বাঙালি হিন্দুর মেরুদন্ড আর সোজা নেই। এ জন্য তাকে একতরফা দোষারোপ করা যাবে না। ভয়ংকর রাজনীতি তার মেরুদণ্ড ভেঙে দিয়েছে আজ অনেকদিন। দেশ শাসনে থাকতে যারা করুণা করে, তারা চলে গেলেও মার খাওয়া হিন্দু বাঙালি চাইলেও মেরুদণ্ড সোজা রাখতে পারে না। সবার ওপরে আছে হিংসা আর পারস্পরিক অশ্রদ্ধাবোধ। আমরা জানি মেধাবী জাতিগোষ্ঠী নামে পরিচিতরা সব সময় পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধে থাকে অবিচল। এমন নজির ভুরিভুরি। প্রশ্ন হচ্ছে বাঙালি হিন্দু যদি মেধাবী হয়, তো তারা কাউকেই শ্রদ্ধা বা মানতে চায় না কেন? এ প্রশ্নের উত্তর দেবেন তারা যারা সমাজ চালায় বা আমাদের সংগঠিত করে। আমার একটাই কথা মেয়ে ঘরে এসে যেন নিরাপদ থাকে।

আমরা যারা গণতান্ত্রিক দেশ ও উন্নত বিশ্বে বসবাস করি, আমাদের জন্য এগুলো সমস্যা নয়। আমাদের সমস্যা ছুটির দিন বা তেমন কিছু। আমাদের একটা দায় তো আছে। আমি একা ভালো থাকলে পূজাকে উৎসব রূপে পালন করলে তো সবাই ভালো থাকবে না। এই বোধটুকু জাগ্রত হওয়ার নামই ঐক্য।

ওই যে মেয়েটি আসে এবং আসবে। যুগে যুগে, কালে কালে বহু মান-অপমান আর ঝগড়া-বিবাদ পেরিয়ে সংঘাতকে পায়ে দলে সে এসেছে। কখন যে তার রুদ্ররূপে কী ভেসে যায় কারা ভেসে যায়, সেটা যারা ভাসে বা ভেসে যায়, তারাও টের পায় না। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে, মেয়েটিকে আমরা কন্যা হলেও জননী জ্ঞান করি। যার নাম দুর্গা।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সহজ ও গতিশীল করার সুপারিশ

আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সহজ ও গতিশীল করার সুপারিশ

আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি ছানোয়ারসহ ৩ নেতা রিমান্ডে

আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি ছানোয়ারসহ ৩ নেতা রিমান্ডে

অপারেশন ডেভিল হান্ট : সারাদেশে আরো ৫২৯ জন গ্রেপ্তার

অপারেশন ডেভিল হান্ট : সারাদেশে আরো ৫২৯ জন গ্রেপ্তার

হত্যা মামলায় মেনন, ইনু,ফারজানা ও শাকিল রিমান্ডে

হত্যা মামলায় মেনন, ইনু,ফারজানা ও শাকিল রিমান্ডে

সব খবর

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App