×

পূজা বিশেষ : শারদ দিনের প্রীতি সম্ভাষণ

দুর্গতি নাশ হোক

বিভুরঞ্জন সরকার

Icon

প্রকাশ: ১১ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

দুর্গতি নাশ হোক
   

বারো মাসে তেরো পার্বণের মধ্যে বাঙালি হিন্দুর সবচেয়ে বর্ণাঢ্য উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা। দেবী দুর্গা হচ্ছেন অসুরবিনাশিনী এবং দুর্গতিনাশিনী। দেশে যেমন অসুরশক্তি বাড়ছে, তেমনি মানুষের জীবনে দুর্গতিরও শেষ নেই। দুর্গতি নাশ করার জন্যই দেবীর আবির্ভাব। বর্তমানে যে শারদীয় দুর্গোৎসব অনুষ্ঠিত হয়, এই উৎসবকে অনেকে রামায়ণে বর্ণিত দুর্গাপূজার রূপ বলে মনে করেন। কৃত্তিবাসী রামায়ণ মতে, অযোধ্যাপতি রাম ১৪ বছর বনবাসকালে তার স্ত্রী সীতাকে দৈত্যরাজ রাবণ অপহরণ করেন। রাবণের কবল থেকে সীতাকে মুক্ত করার জন্য রাম দৈত্যরাজ রাবণকে বধ করার সিদ্ধান্ত নেন। রামচন্দ্র রাবণের প্রাণনাশে সাফল্য অর্জনের জন্য দেবী দুর্গার কৃপা কামনা করেন ও সে জন্য তিনি আদ্যাশক্তি দেবী দুর্গার আরাধনা করেন। এর আগে দেবী দুর্গা বসন্ত ঋতুতে পূজিত হতেন। কিন্তু যুদ্ধের কারণে রামচন্দ্র শরৎ ঋতুতে দেবীর আশীর্বাদের জন্য প্রার্থনা করেন। যদিও শরৎকাল দেবদেবীদের ঘুমের সময় হিসেবেই পরিচিত। কারণ এ সময় দিন ছোট ও রাত বড় হয় এবং রাত সাধারণত রাক্ষস জাতির পরিচায়ক বলে গণ্য করা হয়। প্রথা অনুযায়ী দেবী দুর্গার অষ্টমীবিহিত সন্ধিপূজায় ১০৮টি নীলপদ্মের প্রয়োজন হয়, কিন্তু অনেক চেষ্টার পরও রামচন্দ্র শুধু ১০৭টি পদ্মের ব্যবস্থা করতে পেরেছিলেন। এ সময় নিরুপায় হয়ে তিনি ১০৮তম পদ্মস্বরূপ তার নিজের চোখ উপড়ে নিতে উদ্যত হন। মা দুর্গা রামের একনিষ্ঠতা দেখে খুশি হয়ে স্বয়ং রামের সামনে আবির্ভূত হন এবং দৈত্যরাজ রাবণকে যুদ্ধে পরাজিত করার জন্য আশীর্বাদ করেন।

মা দুর্গার এই অসময়ে আবাহন বাংলায় ‘অকালবোধন’ হিসেবে পরিচিত হয়। তার পর থেকেই শরৎকালে দেবী দুর্গার পূজা প্রচলিত হয়। শরৎকালীন দুর্গাপূজা শারদোৎসব নামে পরিচিত হয় এবং বাঙালি অধ্যুষিত অঞ্চলে বৃহদাকারে পালিত হয়। বসন্তকালীন দুর্গাপূজা বাসন্তী পূজা নামে পরিচিত, যা ঐতিহ্যগতভাবে মূল দুর্গাপূজা হলেও শারদীয় দুর্গাপূজা উদযাপনের উন্মাদনায় তা প্রায় হারিয়ে গেছে। যাহোক, আর্যরীতির সঙ্গে বাঙালির সৃজনশীলতা যুক্ত হয়ে দুর্গোৎসব বর্তমান রূপ ধারণ করেছে। শরৎকালে আনন্দময়ী দুর্গতিনাশিনী মা দুর্গার আগমন বার্তায় আনন্দমুখর হয়ে ওঠে বাঙালি হিন্দুর মন।

বাংলাদেশে বসবাসকারী সনাতন ধর্মাবলম্বী মানুষের আটপৌরে সংসারে হাজারো না পাওয়ার হতাশা, ব্যর্থতা এবং বিপর্যয়ের মধ্যেও অনেক উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে দেবীদুর্গার উপাসনা করে এই বিশ্বাস নিয়ে যে দেবী তাদের সব দুর্গতি মোচন করবেন।

তবে দুর্গাপূজা উদযাপন নিয়ে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিভিন্ন সময়ের অভিজ্ঞতা খুব সুখকর নয়। পূজার আগে পরে প্রতিমা ভাঙচুরসহ নানা অপ্রীতিকর ঘটনা অতীতে একাধিকবার ঘটেছে। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণে এবারও পূজামণ্ডপ ও হিন্দু সম্প্রদায়ের স্থাপনার ওপর আক্রমণের আশঙ্কা করা হচ্ছে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে পূজা উপলক্ষে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করার দাবি জানানো হয়েছে। সরকার পরিবর্তনের ঘনঘটার মধ্যে গত ৪ আগস্ট থেকে ২০ আগস্ট পর্যন্ত দেশে ২ হাজার ১০টি সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটেছে বলে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে। সরকার আসে সরকার যায়; কিন্তু ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন-সহিংসতা অব্যাহত থাকে বলেও এই সংগঠনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে।

এর মধ্যেই সংঘটিত কয়েকটি ঘটনা সংখ্যালঘুদের মনে উদ্বেগ তৈরি করেছে। ফরিদপুরের ভাঙায় একটি মন্দিরে দুর্গা প্রতিমা ভাঙচুরের খবর গণমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। এ ছাড়া খুলনার দাকোপ উপজেলার বিভিন্ন মন্দিরের পূজা কমিটির কাছে পাঁচ লাখ টাকা করে চাঁদা দাবির উড়ো চিঠির খবরও গণমাধ্যমে ছাপা হয়েছে। এতে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে উদ্বেগ কাজ করছে। কোনো কোনো মন্দির পূজা না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলেও জানা গেছে। রাজধানীর উত্তরার একটি মাঠে দুর্গাপূজা বন্ধ করার দাবিতে মিছিল হয়েছে। কোথাও কোথাও পূজা উদযাপনে নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপের কথাও শোনা গেছে।

সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে অবশ্য হিন্দু সম্প্রদায়কে নিরুদ্বিঘœ চিত্তে পূজা উদযাপনের আশ্বাস দেয়া হয়েছে।

দুই.

অসুর বিনাশই দেবী দুর্গার আরাধনার মূল লক্ষ্য। সে অসুর হতে পারে রাবণ, দুঃশাসন, প্রাকৃতিক দুর্বিপাক কিংবা মানববিনাশী যে কোনো অপশক্তি। প্রশ্ন আসে, তা হলে দুর্গা কে? তিনি এক দেবী। দেবী কে? এক শক্তি। শক্তি কী? কর্ম বা কাজ করার ক্ষমতা। আমরা যে কথা বলি, কথা একটা কাজ। দেখি, শুনি, বুঝি এগুলোও কাজ। শক্তি ছাড়া কাজ হয় না। এ শক্তি কথন শক্তি, শ্রবণশক্তি, দৃষ্টিশক্তি, বোধশক্তি। এ শক্তির নাম দুর্গা। সনাতন ধর্মমতে, বিশ্বব্রহ্মা সৃষ্টির কার্যকারণের তত্ত্বগত ব্যাখ্যায় ঈশ্বরের ট্রিনিটি বা ত্রয়ী অবস্থাকে গ্রহণ করা হয়েছিল। তিনি যখন সৃষ্টি করেন তখন তিনি ব্রহ্মা (সৃষ্টিকর্তা), যখন সৃষ্টি বজায় রাখেন, তখন তিনি বিষ্ণু (পালনকর্তা), যখন নতুন সৃষ্টির মানসে জগৎ ধ্বংস করেন তখন তিনি মহেশ্বর (প্রলয়কর্তা)। বিশ্বেশ্বরের এই সৃষ্টি, পালন ও প্রলয়কার্যে যে এনার্জি (শক্তি) বা ‘কনসাসনেস’ (চেতনা) নদীর মতো বিশ্বজগতের সর্বত্র নিয়ত প্রবহমান তাকে সনাতন ধর্ম প্রকৃতি হিসেবে ব্যাখ্যা করেছে। আসলে দুর্গাদেবীর কাহিনিটি রূপক মাত্র। রাম-রাবণের যুদ্ধ কিংবা মহিষাসুর ও দেবী দুর্গার সংগ্রাম এবং পরিশেষে দুর্গতিনাশিনী দুর্গার দ্বারা মহিষাসুরের পরাজয় প্রকৃতপক্ষে মানুষের অন্তস্থিত দেবতা ও দানবের-শুভশক্তি ও অশুভশক্তির সংগ্রাম। পরিশেষে শুভশক্তির কাছে অশুভশক্তির পরাজয়ের প্রতীক।

আমাদের অন্তর্জগতে যে নিরন্তর শুভ ও অশুভের সংগ্রাম চলছে এবং সেই সংগ্রামে আমরা প্রতিনিয়ত ক্ষতবিক্ষত হচ্ছি, তার বাস্তবতা আমরা কেমন করে অস্বীকার করব? এই সংগ্রাম যেমন অনাদি, তেমনি আপেক্ষিক বিচারে তা অনন্তও। এবং এই সংগ্রাম পুরাণ-কথিত সংগ্রামের চেয়েও কঠিনতর। যতদিন সৃষ্টি থাকবে ততদিন মানুষের মধ্যে এই সংগ্রাম চলতে থাকবে। দুর্গা ও মহিষাসুরের যুদ্ধ যেন মানুষের মধ্যে শুভ ও অশুভের চিরন্তন যুদ্ধের প্রতীক। মানুষের জীবনে দুঃখ-কষ্ট, রোগ-শোক-বঞ্চনা লেগেই আছে। সুখের সামগ্রীতে আধুনিক কম্পিউটার, মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট যুক্ত হয়েও জীবনে যেন শান্তি নেই। ভোগের তীব্র আকাক্সক্ষায় মানুষ আজ দিশাহারা। হিংসা ও বিদ্বেষ দ্বারা চালিত হয়ে হারিয়ে ফেলছে বিচারবুদ্ধি। অর্থ আর ক্ষমতার নেশায় অসুরশক্তি চারদিকে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। ধনগর্ব যাদের সীমাহীন, ভোগলিপ্সা যাদের প্রবল, ক্ষমতার দাপটে যারা ধরাকে সরা জ্ঞান করে, জৈব প্রবৃত্তির যারা দাস, তারাই তো অসুর। দেশে, সমাজে আজ অসুরের ছড়াছড়ি। খুনি, সন্ত্রাসী, ধর্ষক, নারী নির্যাতনকারী, অত্যাচারী, দুর্নীতিপরায়ণ, ব্যাংকের টাকা আত্মসাৎকারী- এরাই তো বর্তমান সময়ে অসুর। এই অসুরদের বিনাশ করতেই শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের যাবতীয় আয়োজন। অসুরদের তাণ্ডবের ভেতরেও এমন কিছু মানুষ আছেন, যারা নিজের বিপদকে তুচ্ছজ্ঞান করে অন্যের হিতের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করতে প্রয়াসী হন। তাদের ভেতরেই দেবীর মঙ্গলশক্তির প্রকাশ।

মনে রাখতে হবে, উৎসব মানুষে মানুষে মিলনের সামাজিক পরিসর। সেই মন্ত্র নিয়েই প্রতিটি উৎসব আমাদের আমন্ত্রণ জানায়। কিন্তু সেই আহ্বানে সত্যিই কি আমরা সমাজবদ্ধ জীব হিসেবে সব সময় সাড়া দিতে পারি? পাশের পরিবেশ, পাশের মানুষের কথা ভাবতে না শিখলে, সমষ্টির গুরুত্ব না বুঝতে পারলে অর্থহীন হয়ে যায় গুরুত্বপূর্ণ এই আয়োজন। প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা রাজনৈতিক অথবা সামাজিক অস্থিরতার কঠিন সময়েও আমরা কি পারি না উৎসবের মর্মার্থ অনুধাবন করতে?

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সহজ ও গতিশীল করার সুপারিশ

আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সহজ ও গতিশীল করার সুপারিশ

আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি ছানোয়ারসহ ৩ নেতা রিমান্ডে

আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি ছানোয়ারসহ ৩ নেতা রিমান্ডে

অপারেশন ডেভিল হান্ট : সারাদেশে আরো ৫২৯ জন গ্রেপ্তার

অপারেশন ডেভিল হান্ট : সারাদেশে আরো ৫২৯ জন গ্রেপ্তার

হত্যা মামলায় মেনন, ইনু,ফারজানা ও শাকিল রিমান্ডে

হত্যা মামলায় মেনন, ইনু,ফারজানা ও শাকিল রিমান্ডে

সব খবর

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App