শ্রী দুর্গার আবাহনে কবিতা প্রসঙ্গে
ফরিদ আহমদ দুলাল

প্রকাশ: ১১ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
খুব ছোটবেলা থেকেই দুর্গোৎসব নিয়ে বাঙালির আবেগ আমাকে বিস্মিত করেছিল। সনাতন ধর্মাবলম্বী বন্ধুদের আবেগের সঙ্গে যুক্ত হতে যৌবন বয়সে বেশকিছু উৎসব আয়োজনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার সুযোগ এসেছিল; কেবল দুর্গোৎসব নয়, শ্যামাপূজার সঙ্গেও আমি সম্পৃক্ত হয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাও রেখেছি। নিয়মিত পাঠাভ্যাসের কারণে, একসময় খ্রিস্টান এবং সনাতন ধর্মীয় বেশকিছু বই পড়ারও সুযোগ ঘটে; আমাদের শহরে রেলস্টেশনের কাছেই ‘গোস্পেল হল’ নামে ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের একটি প্রতিষ্ঠান ছিল, যেখান থেকে খ্রিস্টধর্মীয় বই ধারে পাওয়া যেত; তারও আগে ওদের ভ্রাম্যমাণ গাড়ি থেকে ‘লোক লিখিত সুসমাচার’ বা ‘মথি লিখিত সুসমাচার’ ইত্যাদি বই সংগ্রহ করে, প্রশ্নপত্র পূরণ করে উপহার হিসেবেও কিছু বই পেতে পেতে একটি ‘ইঞ্জিল শরিফ’ পাওয়ার পরই ‘গোস্পেল হলে’ পৌঁছার অধিকার পেয়েছিলাম। অন্যদিকে সনাতন ধর্মীয় বই পড়ার সুযোগ ছিল না, জানতাম দুর্গাবাড়িতে আর্যধর্মীয় জ্ঞান প্রদায়িনী সংঘে যথেষ্ট ধর্মীয় বই থাকলেও মুসলমান হিসেবে সেখানে প্রবেশাধিকার ছিল না; তবে শহরের বিভিন্ন কীর্তনের আসরগুলোতে ছিল আমার নিয়মিত অংশগ্রহণ। স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে আমার নিয়মিত যাতায়াত ছিল ‘বাংলাদেশ পরিষদে’ কিন্তু সেখানে সনাতন ধর্মীয় বই তেমন ছিল না, থাকলেও আমার নাগালে আসেনি। ঘটনাচক্রে কাছারি পুকুরে (যেটি ময়মনসিংহ ল্যাবরেটরি স্কুলের সম্মুখে) স্নান করতে গিয়ে পায়ে কোমল কিছু ঠেকলো, ভয়ে ভয়ে তুলে দেখি, সেটি বাংলায় লেখা মহাভারত কাব্য। দীর্ঘদিন জলে ডুবে তাতে শ্যাওলা জমে গেছে, পাতাগুলো একটার সঙ্গে অন্যটা জড়িয়ে গেছে; বিশেষ করে রঙিন ছবির পাতাগুলো একবারে আটকে গেছে। ধারণা করি ১৯৭১-এর যুদ্ধের সূচনায় যখন মানুষ দেশ ছেড়ে পালাচ্ছে, তখন কোন হিন্দু পরিবারের ঘরে সংরক্ষিত মহাভারতটি মৃত্যুভয়ে জলে বিসর্জন দিয়ে গেছে। বইটির সঙ্গে ১ মাসের অধিককাল চলল আমার কসরত; গা থেকে শ্যাওলা তুলে নেয়ার প্রাণন্ত চেষ্টা; রোদে শুকানো, বৃষ্টি এলে যতেœ তুলে রাখা, এভাবেই প্রেম হয়ে গেল ‘মহাভারত’ নামের বইটির সঙ্গে। মহাভারতই আমায় নিয়ে গেল গীতার কাছে; অতঃপর এলোমেলো সনাতন ধর্মীয় অন্যান্য গ্রন্থ পাঠে আগ্রহ। আসলে পাঠে কিছুটা পাগলই ছিলাম একসময়; কায়দা-সিপারা-কুরআন শিশুকাল থেকে পাঠে এসেছে পারিবারিক আবহে, বিশেষত আমার মার আগ্রহে পড়লেও ইসলাম ধর্মীয় পাঠ আমার পরিণত বয়সেই। অনেক পড়ার পর, এখন মনে হয়, ধর্মীয় পাঠে আমি মূর্খই প্রায়। যা হোক, আমার আজকের প্রসঙ্গ শ্রী দুর্গাকে নিয়ে লেখা কবিতা প্রসঙ্গে। কবিতাকে সাধারণের স্বার্থে ব্যবহারের জন্য মহাজাগতিক ব্যাঞ্জনায় ঈশ্বরের মুখোমুখি দাঁড় করানোর কৌশল হিসেবে শ্রী দুর্গার শরণাপন্ন হতে চেয়েছি। কেন না শ্রী দুর্গা বা তার ভক্তদের মধ্যে ভিন্ন মতে মনোযোগী হওয়ার যে সহিষ্ণুতা আমি প্রত্যক্ষ করেছি আমার পরিপার্শ্বে, তা-ই আমায় পরবর্তী সময় আগ্রহী করেছে কবিতা লিখতে।
বন্ধুদের অনুরোধে বিভিন্ন উৎসবে আমি দেবী দুর্গাকে নিয়ে বিভিন্ন সময় হয়তো পনেরো-বিশটি কবিতা লিখেছি, এছাড়াও সরস্বতী বন্দনায় হয়তো গোটা দশেক কবিতা লিখেছি; এসব লিখতে গিয়ে ভারতীয় পুরাণ বিষয়ে আমার আগ্রহ বেড়ে গেছে; আমার লেখা কবিতাগুলো যে সযতেœ সংরক্ষিত আছে তা-ও নয়; তারপরও যা পাওয়া যায় তাই নিয়ে স্মৃতিচারণের চেষ্টা করছি। একটি কবিতা উদ্ধৃতি দিচ্ছি-
তোমার এ পিতৃভূমি সম্প্রীতির সুদৃঢ় অতীত
বিপন্ন সময়ে এসে সম্প্রীতি ও ভালোবাসা হয়েছে পতিত;
নদীতীরে শরতে যখন ফোটে কাশ ফুল
ভোর হলো ভেবে ঝরে শিউলি-¯িœগ্ধ শিশিরের ভুল
বর্ণিল মেঘেরা জড় হয় অভিবাদন সংগীতে এসে
স্নেহ-পুষ্প বর্ষণ তোমার সর্বধর্ম সন্তানের বিনম্র উষ্ণীষে।
........................................
দুর্গতিনাশিনী তুমি আদ্যাশক্তি দশভুজা দেবী
ভক্তের আকুতি নিয়ে তোমার চরণ যারা সেবী
তাদের রক্ষার্থে তুমি অসুর বিনাশ করো আজ
এই নাও দিয়েছি তোমায় পরিয়ে রণরঙ্গিনী সাজ;
আমাদের সীমানা ঘৃণা ও ক্ষোভ প্রকাশের আয়োজনে
আনুষ্ঠানিকতা উচ্চারণ করি সুশীলেরা মানববন্ধনে।
নব্য অসুরেরা যারা সম্প্রীতির আব্রু ছিঁড়ে দেয়
যারা জনপদে শান্তি ভেঙে স্বস্তি কেড়ে নেয়
প্রতিহত করো তাদের তোমার দণ্ড-গদা-শঙ্খ-চক্রে
ধনুর্বান-খড়্গ-ত্রিশূল জাগ্রত করো পিশাচে সর্বাগ্রে
বর দাও যেন প্রতিরোধে জেগে উঠি ঘুমন্ত সবাই
একাত্তরে পরাস্ত করেছি যাদের তাদের যেন আবার হারাই।
(শ্রী শ্রী দেবী দুর্গার প্রতি \ ফরিদ আহমদ দুলাল)
কবিতাটি ২০১২-এর অক্টোবরে লেখা; সে সময়ের চিত্রও এখানে আছে। সে সময় আমরা দেখেছি সাম্প্রদায়িক বিপর্যয়; টেকনাফ-উখিয়া-রামুতে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান কী নৃশংসভাবে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে! পৃথিবীর কোথাও কোনো সংখ্যালঘুর ওপর যেন কখনো এ ধরনের অমানবিক নির্যাতন না করা হয়; সে দায়িত্ব সচেতন সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের।
যুগ-যুগান্তরের সুপ্রাচীন ধরণিতে শুভ শারদোৎসবের প্রস্তুতি পর্বে সর্বমঙ্গলা দেবী দুর্গার আগমনে সবাইকে উৎসবে স্বাগত জানাই, সঙ্গে শুভ কামনাও। শাস্ত্র নির্ধারিত সময়ে পূজামণ্ডপে মাতৃবন্দনার শুভ সূচনা হোক বোধন-আবাহন, পূজা ও আরত্রিকের মাধ্যমে। উৎসবের কোথাও যেন কারো মনে ভয় বা দ্বিধা কাজ না করে; সনাতন ধর্মাবলম্বী কারো মনে যেন এমন চিন্তা না আসে, এ দেশে তারা সংখ্যালঘু! ১৯৭১-এ যখন এই বাংলাদেশের জন্ম হয়, সেই জন্মের সঙ্গে এ দেশের হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান, বাঙালি এবং বিভিন্ন ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর মানুষ জীবন উৎসর্গ করে যুদ্ধ করেছে; ৯ মাসের যুদ্ধকালীন সময়ের যত দুর্যোগ, সবই সমানভাবে ভাগ করে নিয়েছে নিজেদের মধ্যে। কারো জীবনেই সামান্য স্বস্তির অবকাশ ছিল না। আমাদের ত্যাগকে যদি বাটখারায় তুলে ওজন করা হয়, আমার বিবেচনায় তুলনামূলক বিচারে ১৯৭১-এ দেশের সনাতন ধর্মাবলম্বী মানুষের ওপর অন্যদের চেয়ে বেশি নির্যাতন হয়েছে; তার পরও বলতে চাই, আমাদের সবার ত্যাগ সমান, প্রাপ্তিযোগটিও সমান হোক। প্রত্যেক ধর্মাবলম্বীর ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসব সমান মর্যাদায় উদযাপনের সুযোগ পাক সবাই এবং এ অধিকার নিশ্চিত করবে সরকার। যদি সরকার অধিকার নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে তাদের ক্ষমাপ্রার্থনা করে পদত্যাগ করা উচিত; এ ঔচিত্যবোধ কেবল আজ নয়, বরং সবসময়।
অধিকারের বৈষম্য দূর করতে একজন সংস্কৃতিকর্মী হিসেবে আমি কাজ করতে চাই। বৈষম্য দূর করার কথা বলতে গিয়ে নিজেকেও দেবীর ভক্তকুলের সঙ্গে যুক্ত করে আবাহন করি তাকে-
বুকে হাত রেখে অকপট উচ্চারণে সত্য বলো-
কখনো কি দেখেছো পেছন ফিরে তোমার বিদায়ে
কত কোটি চোখ করে ওঠে ছলোছলো!
বারেবারে এসে ফিরে গেছো বারেবারে
জানতে চেয়েছো ক’দিন স্বচ্ছন্দে খাই আর ক’দিন কাটাই অনাহারে!
বল কোথায় তোমায় নিয়ে হয় আলোকোজ্জ্বল উৎসব আয়োজন
কোন স্পর্ধায় দুর্বৃত্ত অসুরের দল ভাঙে তোমার ভক্তের মন!
....................................
(দেবী আবাহন \ ফরিদ আহমদ দুলাল)
দুর্গোৎসবের ধর্মীয় ও সামাজিক গুরুত্বের কথা যদি ভাবি, কেন প্রতি বছর দুর্গোৎসব আয়োজন? তাহলে বলতে পারি, বাঙালির মননে এ উৎসবের বহুমুখী গুরুত্ব এবং তাৎপর্য আছে; প্রথমত পুরাণ মতে, পৃথিবী যখন পাপাচারে ডুবে যাচ্ছে, দেবতাকুল যখন বারবার পরাজিত-অপদস্ত হচ্ছে অসুরদের কাছে। মহিষাসুর নামের অসুর, যিনি পূজা-আর্চার মাধ্যমে ব্রহ্মার কাছ থেকে বর আদায় করে নেন, কোনো দেবতা অথবা মানুষ, কোনো পুরুষ বা অসুর; অথবা কোনো দৈবদুর্বিপাক তাকে হত্যা করতে পারবে না; ইত্যাদি। সবার কাছে অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠলেন মহিষাসুর। বিপদগ্রস্ত দেবতাকুল ব্রহ্মার শরণাপন্ন হলেন এবং ব্রহ্মার পরামর্শে তারা দেবী দুর্গার সাহায্য প্রার্থনা করলেন। দেবী দুর্গা যুদ্ধসাজে সজ্জিত হলেন; বিভিন্ন দেবতার নানান অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে অবতীর্ণ হলেন ধরায়। দশভুজা দুর্গা দেবীকে যুদ্ধসাজে সাজাতে বিষ্ণু দিলেন চক্র; স্বয়ং মহাদেব দিলেন ত্রিশূল; বরুণ দেব দিলেন শঙ্খ; দেবরাজ ইন্দ্র দিলেন বজ্র; জমরাজ দিলেন গদা; পবন দেব দিলেন তীর-ধনুক; বৈষম্য আর অশুভকে দূর করতে তার হাতে ছিল তলোয়ার; দেবরাজ ইন্দ্রের বাহন হাতি দিয়েছিল ঘণ্টা; প্রজাপতি ব্রহ্মা দেবীর হাতে তুলে দেন পদ্ম; আর সর্প তুলে দেন শেষনাগ। ফলে মহিষাসুর পরাস্ত হলো, দুর্গতি থেকে মুক্তি পেল পৃথিবী; তাই তিনি দুর্গতিনাশিনী। দুর্গোৎসব তাই দেবীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাবার উৎসব। দ্বিতীয়ত, দেবী দুর্গা, যিনি হিমালয়ের কৈলাসে স্বামী মহাদেবের সঙ্গে থাকেন; প্রতি বছর নির্দিষ্ট তিথিতে তিনদিনের জন্য ধরিত্রীকন্যা ‘উমা’ পিত্রালয়ে নাইওর আসেন; প্রিয় কন্যার আগমনে তিনদিনের জন্য পৃথিবীর এ উৎসব। তৃতীয়ত, শ্রী দুর্গা পৃথিবীর কন্যা হলেও তিনি মহাপরাক্রম, তিনি আদ্যাশক্তি, তিনি বিপদতাড়িনী; বাঙালির দেবী দুর্গা তাই ঘরের মেয়ে; যার কাছে নির্দ্বিধায় বাঙালি অকপট হতে পারে; নিজের যে কোনো সংকট আর অনটনের কথা সহজেই উচ্চারণ করা যায়; সঙ্গতকারণেই সনাতন ধর্মাবলম্বী বাঙালির কাছে দুর্গোৎসব প্রাণের উৎসব। দেবী দুর্গাকে আমরা কতটা পারিবারিক আবহে বরণ করি, তার একটা নমুনা নিচে দিচ্ছি-
তোমার জন্য ভোরের স্বপ্ন সযতেœ বুকে রাখি
সামান্য কই অবাক যখন সবটা থাকলো বাকি
মুক্তাগাছার মণ্ডা দিলাম পোড়াবাড়ির ঘি-মিষ্টি
তোমার জন্য শ্রাবণ দিলাম অবিরাম টানা বৃষ্টি
তোমার জন্য মাংস পোলাও ইলিশ মাছের ভাজা
দুগ্ধ এবং চাটনি দিলাম তিলের মিষ্টি খাজা
ও পারের চরে কাশফুল তুমি শরৎ মেঘের ভিড়
............................
(শারদীয়া উপহার/ ফরিদ আহমদ দুলাল)
নিরাপদ হোক সর্বধর্মীয় মানুষের সাংস্কৃতিক জীবন; চিন্তা-মনীষা আর মননে মানুষ মুক্ত হোক; চিন্তা ও চেতনায় সবাই সর্বমানবিক হোক। স্বয়ং দশভুজা যদি আমাদের পরিত্রাণ না-ও করে, আমরা নিজেরাই যেন আত্মশক্তিতে বলিয়ান হয়ে শ্রী দুর্গার চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে উঠি; সনাতনী বন্ধুরা যেন সেই মন্ত্রে কল্যাণব্রতে জেগে উঠি।