×

পূজা বিশেষ : শারদ দিনের প্রীতি সম্ভাষণ

ধ্যানমন্ত্রে দেবী দুর্গা ও তৎসংশ্লিষ্ট দেব দেবীর রূপ ও স্বরূপ

নিরঞ্জন অধিকারী

Icon

প্রকাশ: ১১ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ধ্যানমন্ত্রে দেবী দুর্গা ও তৎসংশ্লিষ্ট দেব দেবীর রূপ ও স্বরূপ
   

সনাতন ধর্মানুসারে উপাসনা দুই প্রকার : নিরাকার উপাসনা ও সাকার উপাসনা।

নিরাকার উপাসনা : নিরাকার উপাসনায় ঈশ্বরের কোনো রূপ সামনে না রেখে তার উপাসনা করা হয় আমরা জানি ঈশ্বর নিরাকার ধর্মবিশেষে কেবল নিরাকার ঈশ্বরের উপাসনা করা হয়। অন্তর উপলব্ধি করতে হয় তার শক্তিমান ও দয়াশীল বৈশিষ্ট্য। আবার কোনো কোনো ধর্মের বিশ্বাস, ঈশ্বর নিরাকার, তবে তিনি সর্বশক্তিমান। ইচ্ছা করলে তিনি সাকারও হতে পারেন। সনাতন ধর্ম বা হিন্দু ধর্মে ঈশ্বরের নিরাকার ও সাকার- এ দুই রূপেই তার উপাসনা করার বিধান রয়েছে।

দেব-দেবীরা ঈশ্বরের কোনো কোনো গুণ ও শক্তির সাকার রূপ। দেব-দেবীরা ঈশ্বর নন। ঈশ্বরের কোনো না কোনো বিশেষ গুণ কোনো না কোনো দেব বা দেবীর আকার ধারণ করে।

ঋষিরা তাদের ধ্যান দৃষ্টিতে দেব-দেবীর স্বরূপ উপলব্ধি করেছেন এবং তাদের ধ্যানে দেব-দেবীরা সশরীরে প্রকটিত হয়েছেন। ঋষিরা তাদের ধ্যানলব্ধ রূপ ও স্বরূপকে মন্ত্রে প্রকাশ করেছেন। দেব-দেবীদের পূজা করার সময় ঋষি লব্ধ ধ্যানমন্ত্রে তাদের রূপ ও স্বরূপ বর্ণিত হয়েছে। নিষ্ঠ-ভক্ত মানস নেত্রে তাদের রূপ প্রত্যক্ষ করতে পারেন।

দেব-দেবীরা ঋষিদের ধ্যানমন্ত্রে মানস নেত্রে দৃষ্ট হন। সাধারণ মানুষের পক্ষে এ সব দেব-দেবীকে মানস নেত্রে প্রত্যক্ষ করা দুঃসাধ্য। তাই ধ্যানমন্ত্রে বর্ণিত দেব বা দেবীর প্রতিমা নির্মাণ করা হয়। এখানে বলা আবশ্যক- প্রতিমা বা মূর্তি এক কথা নয়। প্রতিমা মূর্তি। কিন্তু সব মূর্তি প্রতিমা নয়। প্রতিমার রূপায়কের পেছনে রয়েছে ঋষিদের ধ্যানে পাওয়া দেব-দেবীর রূপ ও স্বরূপ। কিন্তু মূর্তির পেছনে এ রকম ধ্যানলব্ধ রূপ থাকে না। যেমন কোনো মহাপুরুষ বা মহীয়সী নারী বা যে কোনো ব্যক্তির মূর্তি।

ঋষিদের ধ্যানলব্ধ প্রতিমার ‘রূপ’ অনুসারে শিল্পীরা পাথর ধাতু কাঠ বা মাটি দিয়ে প্রতিমা নির্মাণ করেন। তা দেখে সাধারণ ভক্তের মনোসংযোগ ঘটে। তিনি একাগ্র হতে পারেন।

জ্ঞানী ভক্তের জন্য প্রতিমার বাস্তব রূপের প্রয়োজন নেই। তিনি মানুষ নেত্রেই দেব-দেবীর উপলব্ধি করতে পারেন।

এখন আমরা পূজা করার জন্য দেবী দুর্গা ও আরো কয়েকজন দেব-দেবীর শিব, ল²ী, সরস্বতী, কার্তিক ও গণেশের ধ্যানমন্ত্রে বর্ণিত রূপ ও স্বরূপের পরিচয় উপস্থাপন করছি। তার আগে দুর্গা প্রতিমার কাঠামোটির একটু বিশ্লেষণ করছি। কাঠামোতে আমরা যা দেখি তা যেন একটি বিশেষ অবস্থার স্থিরচিত্র। তা হচ্ছে দেবী দুর্গা- সিংহবাহিনী। তার এক পা সিংহের ওপর এবং আরেক পা যুদ্ধের এক পর্যায়ে মহিষাসুরের কাঁধে স্থাপিত। দশ হাতে দশ প্রহরণ ধারিণী দেবী দুর্গা উপবিষ্ট মহিষাসুরের বুকে ত্রিশূল বা বর্শা জাতীয় অস্ত্রবিদ্ধ করছেন। সিংহ থাবা মেরে মহিষাসুরকে বিক্ষত করেছে। ত্রিশূলবৃদ্ধ শরীরের ক্ষতস্থান থেকে এবং সিংহের থাবায় আক্রান্ত স্থান থেকে রক্তপাত হচ্ছে।

দেবী দুর্গা কেবল দশভুজাই নন, তিনি ত্রিনয়না। কপালে তৃতীয় চোখটি আসলে জ্ঞান নেত্র।

দেবী দুর্গার যে দশ হাত- যার জন্য তাকে দশভুজা বলা হয়, তা আসলে প্রতীকী। শ্রীশ্রী চণ্ডী নামক ধর্মগ্রন্থে আছে মহিষাসুর প্রবল পরাক্রান্ত হয়ে স্বর্গ মর্ত্য পাতাল- এই ত্রিলোকের অধীশ্বর হয়ে বসেন। দেবরাজ ইন্দ্রসহ দেবতাদের তিনি বিতারিত করেন স্বর্গরাজ্য থেকে। দেবতাদের স্বর্গরাজ্য থেকে নেমে আসতে হয় পৃথিবীতে।

মহিষাসুরের এ প্রবল পরাক্রমের কারণ ছিল ব্রহ্মার বর। এমনিতেই তিনি শক্তিমান। ব্রহ্মার বরে তার শক্তি আরো বৃদ্ধি পায়। ব্রহ্মা মহিষাসুরকে বর দেন, মহিষাসুরকে কোনো পুরুষ বধ করতে পারবে না।

তবে বরের মধ্যে একটা ফাঁক ছিল। কোনো পুরুষ বধ করতে পারবে না। কিন্তু কোনো নারী তাকে বধ করতে পারবে না, এমন বরতো দেয়া হয়নি। তখন সব দেবতার মিলিত শক্তি থেকে সৃষ্টি হয় জ¦লন্ত পর্বতের মতো এক আলোর পুঞ্জ। সেই আলো পরিণত হয় নারী মূর্তিতে। দেবতাদের সম্মিলিত শক্তি- দশ দিক সমাহিত শক্তির প্রতিমা দেবী দুর্গা। তাই তিনি দশভুজা। এই প্রতীকের তাৎপর্য হলো দেবী দুর্গা ঐক্যবদ্ধ সম্মিলিত শক্তির প্রতীক। লোকশিক্ষার জন্য দুর্গা প্রতিমা নির্মাণের সময় দশটি হাত দেখানো হয় এবং দশ হাতে দশটি অস্ত্র বা প্রহরণ। এ প্রতীকী তাৎপর্য তত্ত্বজ্ঞান না থাকায় তা সাধারণের কাছে দুর্বোধ্য।

দেবী দুর্গার ধ্যানমন্ত্রানুসারেই প্রতিমা নির্মাণ করা হয়েছে। এবারে আমরা ধ্যানমন্ত্রটার অংশবিশেষ উদ্ধার করছি:

জটাজুট সমাযুক্তাং অর্ধেন্দু কৃতশেখরাম্।

লোচনত্রয় সংযুক্তাং পূর্ণেন্দু সদৃশাননাম্\

অতসীপুষ্প বর্ণাভাং সুপ্রতিষ্ঠাং সুলোচনাম্।

নবযৌবন সম্পন্নাং সর্ব্বাভরণ ভূষিতাম্\

জটাজুটযুক্ত, অর্ধচন্দ্রের মতো ললাট বা কপাল ত্রিনয়নী এবং তার মুখমণ্ডল পূর্ণচন্দ্রের মতো, অতসী ফুলের আভার মতো হলদে-সুন্দর গায়ের রং; নবযৌবন তার এবং তিনি সকল প্রকার আবরণে অর্থাৎ অলংকারে ভূষিতা।

এখানে ধ্যানমন্ত্রের অংশবিশেষ উদ্ধার করা হয়েছে। আর এ ধ্যানমন্ত্রানুসারে শিল্পীরা দেবী-প্রতিমা নির্মাণ করেন।

ধ্যানমন্ত্রের পরের অংশে আছে :

দেব্যাস্তু দক্ষিণাং পাদং সমং সিংহোপরিস্থিতম্।

কিঞ্চিৎ ধূর্ধ্বং তথা বামঅঙ্গুষ্ঠং মহিষোপরি\

দেবীর ডান পাশে সিংহের পৃষ্ঠে এবং বাম পা মহিষাসুরের ওপর (কাঁধে)।

আমরা দুর্গা প্রতিমায় এভাবেই তো দেবী দুর্গা, মহিষাসুর ও সিংহকে দেখি। সুতরাং দেখা যাচ্ছে দুর্গা প্রতিমায় দেবী দুর্গা, মহিষাসুর এবং সিংহকে এভাবেই উপস্থাপন করা হয়।

দেবী ল²ী : দেবী দুর্গার ডান দিকে থাকেন ল²ী দেবী। ল²ী দেবী ধ্যানমন্ত্রে আছে :

ল²ী দেবী সুন্দরী, কাঞ্চন অর্থাৎ স্বর্ণের মতো তার গায়ের রং। তিনি স্বরূপা এবং সকল প্রকার অলংকারে ভূষিতা। সঙ্গে থাকে তার বাহন প্যাঁচা।

দেবী সরস্বতী : দেবী সরস্বতীর গলায় মুক্তার হার। মস্তক শশীকলায় অলংকৃত। হাতে থাকে বর্ণমালা এবং বীণা। সঙ্গে থাকে তার বাহন হাঁস।

গণেশ : সিদ্ধিদাতা গণেশ দেব থাকেন দেবী সরস্বতীর ঠিক নিচের সারিতে। তিনি দেবী দুর্গার পুত্র। হাতির মুখের মতো মুখ তার। উপাখ্যান অনুসারে তার প্রকৃত মাথা বিনষ্ট হলে তার মাথায় হাতির মাথা বসিয়ে দেয়া হয়। তার বাহন ইঁদুর। তিনি লম্বোধর অর্থাৎ ভুঁড়িওয়ালা। তিনি কিছুটা খর্বকায় অর্থাৎ লম্বায় খাটো। ধ্যানমন্ত্রে এরূপ বর্ণনায় আছে :

ওঁ খর্বং স্থূলতনুং গজেন্দ্রবদনং লম্বোদরং সুন্দরং ইত্যাদি।

কার্তিক : পক্ষান্তরে কার্তিক অতীব সুন্দর তরুণ। তিনি অনেক বড় যোদ্ধা। দেবতাদের সেনাপতি তিনি। তার বাহন ময়ূর। তিনি ময়ূরের ওপর উপবিষ্ট। অর্থাৎ তার বাহন ময়ূর। তপ্ত স্বর্ণের মতো তার গায়ের রং। তিনি শত্রæ বিনাশ করেন।

ওঁ কার্ত্তিকেয়ং মহাভাগং

ময়ুরোপরিসংস্থিতম্।

তপ্তকাঞ্চনবর্ণাভং শক্তিহস্তং বলপ্রদম্\

দ্বিভুজং শক্রহন্তারং নানালঙ্কারভূষিতম্।

প্রসন্নবদনং দেবং কুমারং পুত্রদায়কম্\

শিব : দেবী দুর্গা শিব জায়া। দেবী দুর্গা যখন শিবনিবাস কৈলাস থেকে মত্তে পিত্রালয়ে আসেন তখন শিবও প্রায় লুকিয়ে তার সঙ্গে শ্বশুরবাড়ি চলে আসেন। উল্লেখ্য, তার গলায় সাপের হার। তবে চেহারাটা সুন্দর। তার হাতে থাকে ডমরু। এরকম জামাই শ্বশুরবাড়িতে সমাদৃত নন। তাই তাকে লুকিয়ে আসতে হয়।

দুর্গা প্রতিমার কাঠামোর মধ্যে তাই খুব ছোট আকারে কোনোমতে শিবের অবস্থান। প্রকৃতপক্ষে কত বড় তিনি। একই সঙ্গে তিনি মঙ্গলদাতা এবং জীবের সংহার কর্তা। তার সর্পাদি সংযুক্ত অবস্থা ভীতিকর। এ যেন দেবাদিদেব মহাদেবের এক পরম কৌতুক। অথচ রূপের দিক থেকে তিনি রজতগিরিনিভ, চারুচন্দ্রাবতংশ, রতেœর মতোই শুভ্র সমুজ্জ্বল তার গাত্রবর্ণ। তিনি ত্রিনয়ন অর্থাৎ দেবী দুর্গার মতো তিনিও ত্রিনয়ন। কপালে তৃতীয় শক্তি আসলে জ্ঞান নেত্র।

এতক্ষণের আলোচনায় আমরা নিশ্চয়ই উপলব্ধি করতে পেরেছি দুর্গা প্রতিমার কাঠামোতে সন্নিবিষ্ট দেবী দুর্গা ও অন্যান্য দেব-দেবীর যে রূপ ও স্বরূপ, তা ঋষি কল্পনায় বা তাদের ধ্যানমন্ত্রের দৃষ্ট রূপ।

শিল্পীরা ধ্যানমন্ত্রানুসারেই প্রতিমা নির্মাণ করেন, যা আবার বিমূর্ত বৈশিষ্ট্যের মূর্ত রূপ। যেমন দেবী দুর্গা বিশ্ব নিয়ন্তা মহাশক্তিধর ঈশ্বরের শক্তি রূপ। দেবী ল²ী তারই ধনদায়ক শক্তির প্রতীমা। দেবী সরস্বতী তারই বিদ্যাদানের ক্ষমতার প্রতিভূ। সিদ্ধিশক্তি গণেশ, তারুণ্য ও শৌর্য-বীর্যের প্রতিভূ কার্তিক ইত্যাদি।

সনাতন বা হিন্দু ধর্মের এই প্রতীকী তাৎপর্য উপলব্ধি না করার ফলেই তাকে প্রাণহীন পুতুল পূজা বলেই মনে হয়। সনাতন ধর্মাবলম্বী বা হিন্দুদের পৌত্তলিক বলা হয়। কিন্তু প্রতিমা (পুতুল নয়) প্রকৃত তাৎপর্য উপলব্ধি করলে এই সংশয় থাকে না। মহাশক্তিমান ঈশ্বরই মূল। দুর্গা-ল²ী প্রভৃতি দেবদেবী সেই মূলের অংশীভূত- এ তাৎপর্যও সমুদ্ভাসিত হয়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সহজ ও গতিশীল করার সুপারিশ

আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সহজ ও গতিশীল করার সুপারিশ

আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি ছানোয়ারসহ ৩ নেতা রিমান্ডে

আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি ছানোয়ারসহ ৩ নেতা রিমান্ডে

অপারেশন ডেভিল হান্ট : সারাদেশে আরো ৫২৯ জন গ্রেপ্তার

অপারেশন ডেভিল হান্ট : সারাদেশে আরো ৫২৯ জন গ্রেপ্তার

হত্যা মামলায় মেনন, ইনু,ফারজানা ও শাকিল রিমান্ডে

হত্যা মামলায় মেনন, ইনু,ফারজানা ও শাকিল রিমান্ডে

সব খবর

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App