মমতার প্রশ্নে ভারতে বসবাসরত বাংলাদেশি বংশোদ্ভূতরা খানিক স্বস্তি পেলেও ভয় কাটেনি

অভিজিৎ ভট্টাচার্য্য (ঢাকা) ও ঋষি চক্রবর্তী (কলকাতা)
প্রকাশ: ২৭ জুন ২০২৫, ১০:১৩ পিএম

ছবি: সংগৃহীত
ভোটার তালিকা নিয়ে বিপাকে পড়া বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশ থেকে ভারতে যাওয়া বাসিন্দাদের কিছুটা স্বস্তি দিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তবে তাতে ভয় কাটেনি। বৃহস্পতিবার বিকেলে পশ্চিমবঙ্গের দিঘা থেকে ভারতের কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশন ও বিজেপির সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করে কড়া ভাষায় আক্রমণ করলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
সম্প্রতি ভারতজুড়ে অবৈধ ভোটারদের বাদ দিয়ে ভোটার তালিকায় স্বচ্ছতা আনতে সংশোধনের কাজ করছে জাতীয় নির্বাচন কমিশন। সেই কারণে বিভিন্ন রাজ্যের কাছে পাঠানো হয়েছে একটি ‘ডিক্লারেশন ফর্ম’। যার বেশ কিছু নিয়মাবলি নিয়ে আপত্তি তুললেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বৃহস্পতিবার দিঘা থেকেই এনিয়ে সরব হয়ে তিনি বললেন, ভোটার তালিকা সংশোধন করার জন্য আমাদের কাছে কমিশন একটা ফর্ম পাঠিয়েছেন। কিন্তু সেই ডিক্লারেশন ফর্মের কয়েকটি বিষয় আমার আপত্তি আছে। কেন উল্লেখ করা হচ্ছে, ১৯৮৭ থেকে ২০০২-এর মধ্যে যাদের জন্ম, তাদের তা লিখতে হবে ফর্মে? তার মানে কি তার আগে বা পরে যারা জন্মেছে, তাদেরটা হবে না?
প্রসঙ্গত, পশ্চিমবঙ্গে কয়েক লাখ ভোটার আছেন যারা বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন সময়ে গিয়ে বসবাস করছেন। তারা বেআইনি ভাবে ভোটার তালিকায় নাম নথিভুক্ত করেছেন। উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলায় শতাধিক পরিবারের বিরুদ্ধে নালিশ করেছে স্থানীয় তৃণমূল বিধায়ক থেকে নেতা কর্মীরা। বিজেপিও তাদের পাশে দাঁড়ায়নি। ফলে ওই পরিবারের সদস্যরা পড়েন বিপাকে। জমি কিনে বাড়ি করে বসবাস করছেন। তাদের সন্তানরা ভোটার তালিকায় কেউ নথিভুক্ত করেছেন আবার কেউ করার আবেদন করেছেন। জন্মের শংসাপত্র চাওয়ায় কয়েক লক্ষ পরিবারের সদস্যরা পড়েছেন বিপাকে।
বিজেপি সূত্রের দাবি, তারা চাইছেন এই নাগরিকরা সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের নাগরিকত্ব ফর্ম ফিলাপ করে আবেদন করুক। পশ্চিমবঙ্গ ও দিল্লির দুই শাসক দলের রাজনৈতিক বিরোধিতার মাঝে পড়েছেন বাংলাদেশী বংশোদ্ভূতরা।
এই মুহূর্তে রথযাত্রা উপলক্ষে দিঘায় রয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বৃহস্পতিবার বিকেলে সেখান থেকেই জরুরি সাংবাদিক সম্মেলন করে নির্বাচন কমিশনের নয়া ডিক্লারেশন ফর্ম নিয়ে আপত্তি জানালেন। তার দাবি, নির্বাচন কমিশন তাকে ২টি চিঠি পাঠিয়েছে। তা প্রাথমিকভাবে দেখতে গিয়ে ১৮ ও ১৯ পাতার নির্দেশিকায় তার চোখে পড়েছে যে ওই ডিক্লারেশন ফর্ম পূরণের সময় বাবা-মায়ের বার্থ সার্টিফিকেটও দিতে হবে। তা কোথা থেকে পাবেন সবাই-এই প্রশ্ন তোলেন মুখ্যমন্ত্রী। এ প্রসঙ্গে নিজের কথা বলতে গিয়ে মমতা বলেন, আমিও নিজের মা-বাবার জন্মসাল জানি না।
অবৈধ ভোটারদের তালিকা থেকে বাদ দিতে ২২ বছর পর নড়েচড়ে বসেছে জাতীয় নির্বাচন কমিশন। বিশেষ করে ভিনদেশি নাগরিকদের তালিকা থেকে বাদ দিতেই কমিশনের এই পরিকল্পনা বলে জানা গিয়েছে। নতুন ভোটারদের তালিকাভুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রেও বেশ কয়েকটি পরিবর্তন আনা হয়েছে। জন্মের প্রমাণপত্র সঠিকভাবে দাখিল করতে না পারলে ভোটার তালিকায় নাম তোলা যাবে না বলে স্পষ্ট জানিয়েছে কমিশন।
আর এখানেই আপত্তি বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর। তার সংশয়, এসব তথ্য নিয়ে কি আসলে এনআরসি-র পথে এগোচ্ছে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার? এ প্রসঙ্গে জনতাকেও সতর্ক করেছেন মমতা। বার্তা দিয়েছেন, আপনারাও বিষয়টি নজরে রাখুন। ফর্মে দেখে নিন ভালো করে। আপত্তিজনক কিছু মনে হলে তা করবেন না। দরকারে সমবেত প্রতিরোধ গড়ে তুলুন। দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি, কমিশনের উদ্দেশ্য ভালো নয়। তবে এনিয়ে তৃণমূল নতুন করে প্রতিবাদে নামছে কিনা, তা এখনও স্পষ্ট করেননি দলনেত্রী।
এদিকে, গতকাল শুক্রবার এএফপির এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, ভারত বিনা বিচারে শত শত মানুষকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। আর এই বিষয়টি দুই দেশের কর্মকর্তারাও নিশ্চিত করেছেন। মানবাধিকারকর্মী ও আইনজীবীরা বলছেন, এই নির্বাসন বা বিতাড়ন প্রক্রিয়াটি বেআইনি এবং জাতিগত পরিচয়ের ওপর ভিত্তি করে চালানো হয়েছে। ভারতের দাবি, যাদের ফেরত পাঠানো হয়েছে তারা ‘অবৈধ অভিবাসী’। কিন্তু মানবাধিকারকর্মীদের ভাষ্য, এই প্রক্রিয়া বেআইনি এবং ধর্মীয় বিদ্বেষপ্রসূত।
বার্তা সংস্থাটি বলছে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির হিন্দু জাতীয়তাবাদী সরকার দীর্ঘদিন ধরেই অভিবাসন, বিশেষ করে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশ থেকে আসা অভিবাসীদের ব্যাপারে কঠোর অবস্থানে রয়েছে। শীর্ষ কর্মকর্তারা অতীতে এসব অভিবাসীদের ‘উইপোকা’ বা ‘অনুপ্রবেশকারী’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। এতে ভারতের প্রায় ২০ কোটির মতো মুসলমান, বিশেষ করে বাংলা ভাষাভাষী মুসলমানদের মধ্যে ব্যাপক আতঙ্ক তৈরি হয়েছে।
ভারতের বিশিষ্ট মানবাধিকারকর্মী হর্ষ মন্দার বলেন, বিশেষ করে দেশের (ভারতের) পূর্বাঞ্চলের মুসলমানদের মধ্যে ভীষণ ভয় ও উদ্বেগ বিরাজ করছে। যেন তাদের অস্তিত্বই এখন হুমকির মুখে। ২০২৪ সালে ঢাকায় সরকার পতনের পর দুই দেশের সম্পর্কে টানাপোড়েন তৈরি হয়। বাংলাদেশ যেটি প্রায় সম্পূর্ণরূপে ভারতের স্থলসীমানায় ঘেরা অতীতে ভারতের ঘনিষ্ঠ মিত্র ছিল।
কাশ্মির হামলার পর লাগামহীন দমন-পীড়ন : গত ২২ এপ্রিল ভারতশাসিত কাশ্মিরে ২৬ জন (যাদের বেশিরভাগই হিন্দু পর্যটক) নিহত হওয়ার ঘটনায় ভারত পাকিস্তানকে দায়ী করে। যদিও ইসলামাবাদ তা অস্বীকার করে। এর জেরে চারদিনের সীমান্ত সংঘাতে ৭০ জনের বেশি প্রাণ হারায়। এই ঘটনার পর ভারতজুড়ে নজিরবিহীন নিরাপত্তা অভিযান শুরু হয়। হাজার হাজার মানুষকে আটক করা হয় এবং অনেককেই বাংলাদেশ সীমান্তে নিয়ে গিয়ে বন্দুকের মুখে জোর করে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়া হয়।
আসামের রহিমা বেগম নামে এক নারী জানান, গত মে মাসের শেষদিকে তাকে পুলিশ কয়েকদিন আটকে রাখে। পরে পাঁচজন মুসলিমসহ তাকে বাংলাদেশ সীমান্তে নিয়ে যাওয়া হয়। রহিমা বলেন, আমার জন্ম, বাবা-মা, দাদা-দাদি সবাই এখানকার। জানি না কেন আমাদের সঙ্গে এমন করা হলো। এএফপি বলছে, রাতের অন্ধকারে তাদের জলাভূমির দিকে নিয়ে যাওয়া হয় এবং বলা হয়, ওই দূরের গ্রামে হামাগুড়ি দিয়ে পৌঁছাও। দাঁড়াতে চেয়ো না, দাঁড়ালে গুলি করে দেব। বাংলাদেশের স্থানীয় বাসিন্দারা তাদের খুঁজে পেয়ে বর্ডার গার্ডের কাছে তুলে দেয়। এরপর বাংলাদেশি বাহিনী তাদের মারধর করে এবং ভারতীয় ভূখণ্ডে ফিরে যেতে বলে।
ফিরে যাওয়ার সময় সীমান্তের ওপার থেকে গুলি ছোঁড়া হয় বলে রাহিমা জানান। তার ভাষায়, আমরা ভেবেছিলাম, এখানেই শেষ। সবাই মারা যাব। এক সপ্তাহ পর তাকে ফের আসামে এনে ছেড়ে দেয়া হয়, তবে সতর্ক করে দেয়া হয় ‘চুপচাপ থাকো’।
নয়াদিল্লিভিত্তিক আইনজীবী সঞ্জয় হেগড়ে বলেন, কোনো রাষ্ট্র কাউকে ফেরত পাঠাতে পারে না যদি না গ্রহণকারী রাষ্ট্র তাদের স্বীকার করে। আইনি প্রক্রিয়া ছাড়াও কাউকে নির্বাসন দেয়া বা বিতাড়ন করা বেআইনি। বাংলাদেশ সরকার জানিয়েছে, চলতি বছরের মে মাস থেকে এখন পর্যন্ত ভারতের পক্ষ থেকে ১৬শ জনকে সীমান্তে ঠেলে পাঠানো হয়েছে। তবে ভারতীয় গণমাধ্যমে দাবি, প্রকৃত সংখ্যা ২৫শ জনেরও বেশি। বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষীরা বলছে, ফেরত পাঠানোদের মধ্যে অন্তত ১শ জন প্রকৃত ভারতীয় নাগরিক ছিলেন, যাদের তারা আবার ভারতে ফিরিয়ে দিয়েছেন। অধিকারকর্মীরা বলছেন, মোদির ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) শাসিত রাজ্যগুলোতেই বেশি নির্যাতন চলছে, যেখানে অনেকেই নিম্নবেতনভোগী শ্রমিক তাদের বেশিরভাগই বাংলা ভাষাভাষী মুসলমান।
গুজরাটের পুলিশপ্রধান জানিয়েছেন, রাজ্যজুড়ে ৬ হাজার ৫শ জনকে আটক করা হয়েছে। তাদের অনেকেই বাংলা ভাষাভাষী ভারতীয় ছিলেন, পরে ছেড়ে দেয়া হয়। হর্ষ মন্দার বলেন, বাংলা ভাষায় কথা বলা মুসলমানদের একটি নির্দিষ্ট চিন্তাধারাভিত্তিক ঘৃণানীতির অংশ হিসেবে টার্গেট করা হচ্ছে। ৩৫ বছর বয়সী নির্মাণশ্রমিক নাজিমুদ্দিন মণ্ডল জানান, মুম্বাই থেকে তাকে পুলিশ তুলে নেয়, এরপর সামরিক বিমানে করে ত্রিপুরা সীমান্তে নিয়ে যায় এবং জোর করে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়। পরে তিনি কোনোভাবে ফিরে এসে বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গে আছেন। তিনি বলেন, আমি সরকার-প্রদত্ত পরিচয়পত্র দেখালাম, কিন্তু তারা শুনতেই চায়নি। এখন কাজে বের হতেও ভয় লাগে।